তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনের বহুল আলোচিত ৫৭ ধারায় মামলা নেওয়ার আগে দেশের সব থানাকে পুলিশ সদর দপ্তরকে জানানোর নির্দেশ দেওয়া ছিল। অপপ্রয়োগ হচ্ছে, এ সমালোচনার মুখে সরকার এ নির্দেশ দেয়। কিন্তু নির্দেশ তো মানাই হয়নি, বরং মামলার পরিমাণ আরও বেড়েছে। আর সেসব মামলা করেছেন খোদ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাই।
তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনের অন্যতম বিতর্কিত ধারা ছিল ৫৭। তবে এই ধারা ব্যবহার করে হয়রানির অভিযোগ জানিয়ে আসছিলেন মানবাধিকারকর্মীরা। তখন সরকার বলেছিল, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন চালু হলে ৫৭ ধারার ঝামেলা আর থাকবে না। সরকার নতুন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস করেছে। তবে এই আইনেই ৫৭ ধারার উপাদানগুলো যুক্ত করা হয়েছে। ফলে নতুন করে হয়রানির আশঙ্কা যেমন আছে, তেমনি ৫৭ ধারায় আগে যে মামলাগুলো দায়ের হয়েছে, সেগুলোর বিচারও চলবে।
মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের হিসাবে এ বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ‘হয়রানিমূলক’এমন মামলা হয়েছে ৩৮ টি। ২০১৪ সাল থেকে গত বছর পর্যন্ত মামলার সংখ্যা ছিল কমপক্ষে ৭৫ টি। সে সময় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দলীয় প্রধান, মন্ত্রী ও সাংসদদের নামে ‘কটূক্তি, ক্যারিকেচার করে ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে ভাবমূর্তি নষ্ট করার অভিযোগে তাঁদের পক্ষে মূলত আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা মামলা করেছিলেন। আসামি ছিলেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী, ছাত্র, শিক্ষক, সাংবাদিক, সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী।
তবে চলতি বছরে মামলা দায়ের করা হয়েছে মূলত নিরাপদ সড়ক আন্দোলন ও কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে। শুধু আগস্টেই ২২টি মামলা হয়েছে। বিভিন্ন মামলার আসামিদের মধ্যে রয়েছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আলোকচিত্রী শহিদুল আলম, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মাইদুল ইসলাম, কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন করা শিক্ষার্থীদের সংগঠন বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের তিন যুগ্ম আহ্বায়ক, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গর্ভবতী শিক্ষক ও ব্যবসায়ী।
তবে মানবাধিকার সংগঠনগুলো তাদের নিজস্ব সূত্র থেকে মামলার রেকর্ড রেখেছে। তবে মূল রেকর্ডটি পুলিশের হাতে এবং পুলিশ সদর দপ্তর আন্দোলনকে কেন্দ্র করে কতগুলো মামলা হয়েছে তা প্রকাশ করতে চাইছে না। ঢাকায় পুলিশের সাইবার নিরাপত্তা ও অপরাধ দমন বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, ডিএমপি বাদী হয়ে পাঁচটি মামলা করেছে। র্যাব ও কয়েকজন ব্যক্তিও আলাদাভাবে কিছু মামলা করেছেন।
ডিএমপির সাইবার নিরাপত্তা ও অপরাধ দমন বিভাগের উপকমিশনার মো. আলিমুজ্জামান এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘পুলিশ সুনির্দিষ্ট অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে মামলা দায়ের করেছে। মামলার তদন্ত চলছে। ফরেনসিক পরীক্ষার প্রতিবেদন হাতে পেলে পুলিশ অভিযোগপত্র জমা দেবে।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশের একটি সূত্র অবশ্য প্রথম আলোকে বলেন, নিরাপদ সড়কের দাবিতে যে আন্দোলন, সেটি দ্বিতীয় দিনেই ছাত্রদের হাতছাড়া হয়ে গিয়েছিল বলে পুলিশ খবর পাচ্ছিল। এরপর শিক্ষার্থী হত্যা ও ধর্ষণের গুজব ছড়িয়ে পড়ে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে—এ আশঙ্কা থেকে দ্রুত কিছু মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়।
৫৭ ধারায় ইলেকট্রনিক মাধ্যম ব্যবহার করে মিথ্যা ও অশ্লীল, নীতিভ্রষ্টতা বা অসৎ, মানহানি, আইনশৃঙ্খলার অবনতি, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত ও সংগঠনের বিরুদ্ধে উসকানি—এই সাতটি শব্দকে অপরাধ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। কোনো ব্যক্তি এ ধরনের অপরাধ করলে সর্বোচ্চ ১৪ বছর এবং সর্বনিম্ন ৭ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং সর্বোচ্চ ১ কোটি টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।