সিআইএন ন্যাশনাল ডেক্স :
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় বিএনপির কেউ জড়িত নন বলে দাবি করেছেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি অভিযোগ করেছেন, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে চক্রান্ত করে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ বিএনপি নেতাদের এ মামলায় জড়ানো হয়েছে। ওই মামলায় সঠিক তদন্ত হলে সত্য বেরিয়ে আসত। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে রাজধানীর সেগুনবাগিচায় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর-রুনি মিলনায়তনে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে মির্জা ফখরুল এই কথা বলেন। নব্বইয়ে এরশাদবিরোধী আন্দোলনে শহীদ নাজির উদ্দিন জেহাদের ২৮তম শাহাদাতবার্ষিকী উপলক্ষে সেখানে স্মরণসভার আয়োজন করা হয়। ২০০৪ সালের ২১ অগাস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসবিরোধী শোভাযাত্রায় গ্রেনেড হামলায় আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিহত হন; আহত হন কয়েকশ নেতাকর্মী। সেদিন অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান আজকের প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু গ্রেনেডের প্রচ- শব্দে তার শ্রবণশক্তি নষ্ট হয়। ওই ঘটনায় দায়ের করা দুই মামলার বিচার শেষে রায় ঘোষণার জন্য ১০ অক্টোবর দিন রেখেছে ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল। খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমান, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুসহ মোট ৪৯ জন এ মামলার আসামি। আওয়ামী লীগ অভিযোগ করে আসছে, শেখ হাসিনাকে হত্যা করে দলকে নেতৃত্বশূন্য করতেই এই হামলা হয়েছিল এবং তাতে প্রত্যক্ষ মদদ ছিল তৎকালীন ক্ষমতাসীন বিএনপি-জামায়াত জোটের শীর্ষ নেতাদের। অন্যদিকে বিএনপি নেতারা দাবি করে আসছেন, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে তাদের দলের জ্যেষ্ঠ ভাইস চেয়ারম্যান তারেককে এ মামলায় জড়ানো হয়েছে। বিএনপির আমলে ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার ঘটনায় আওয়ামী লীগ তদন্তে সহযোগিতা করেনি বলে অভিযোগ করেন মির্জা ফখরুল। তিনি বলেন, এক-এগারো সরকারের আমলে দেওয়া অভিযোগপত্রেও তারেক রহমানের নাম ছিল না। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর আবদুল কাহার আকন্দকে তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ দিয়ে তারেক রহমানের নাম অভিযোগপত্রে অন্তর্ভুক্ত করা হয়; সুষ্ঠু তদন্ত না করেই এ মামলার বিচারকাজ চলছে বলেও অভিযোগ তাঁর। সরকার হটানোর শর্টকার্ট কোনো পদ্ধতি নেই এমন মন্তব্য করে নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবি আদায়ে নেতাকর্মীদের রাজপথে নেমে আসার আহ্বান জানান বিএনপির মহাসচিব। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ওই দুর্ঘটনার পর (২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা) বিএনপির চেয়ারপারসন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া সেখানে যেতে চেয়েছিলেন। বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তাঁকে সেদিন যেতে দেওয়া হয়নি। এ ঘটনার পরপরই আমাদের তৎকালীন সরকার সুষ্ঠু তদন্ত করার জন্য সব রকম ব্যবস্থা করেছিল। বিএনপি সরকারই মুফতি হান্নানকে গ্রেফতার করেছিল। মির্জা ফখরুল বলেন, এফবিআই এবং ইন্টারপোলকে নিয়ে আসা হয়েছিল তদন্ত করার জন্য। তিনবার অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছিল। আজকের প্রধানমন্ত্রী তখন কিন্তু বিএনপি নেতা তারেক রহমান ও আবদুস সালাম পিন্টুকে জড়িয়ে কথা বলেননি। এক-এগারোতে তিনি (শেখ হাসিনা) যখন সাবজেলে ছিলেন, তখন মামলা তদন্ত কর্মকর্তা তাঁকে যখন জিজ্ঞাসা করতে যান, তিনি বিএনপি ও তারেক রহমানকে দোষারোপ করেননি। তিনি দোষারোপ করেছিলেন সেনাবাহিনীকে। বিএনপির মহাসচিব দাবি করেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার তদন্ত ভিন্ন দিকে প্রবাহিত হয়েছে। এক-এগারোর সরকারের সময়ে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছিল। সেখানে তারেক রহমানের নাম ছিল না। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরই গোটা পরিস্থিতি বদলে গেল। ৬১ জন সাক্ষী হওয়ার পর তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তন করে নতুন করে তদন্ত কর্মকর্তা করা হলো অবসরপ্রাপ্ত এক পুলিশ কর্মকর্তাকে। যিনি চাকরি হারিয়েছিলেন, পরে আওয়ামী লীগের নমিনেশনও চেয়েছিলেন। তিনি এত বছর পরে মুফতি হান্নানকে ৪১০ দিন রিমান্ডে নিয়ে অমানুষিক নির্যাতন করে তাঁর কাছ থেকে জবাবনবন্দি নিয়েছেন। ওই ঘটনায় প্রকৃত আসামিকে না ধরে আওয়ামী লীগ বিএনপির ওপর দোষ চাপাচ্ছে বলে অভিযোগ করেন মির্জা ফখরুল। বলেন, এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া উচিত ছিল। তা না করে তারা রাজনৈতিকভাবে পুরো বিষয়টিকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে তারেক রহমানসহ বিএনপি নেতাদের জড়াল। এখন তারই সূত্র ধরে একই রেকর্ড বাজাচ্ছে যে এর সঙ্গে বিএনপি নেতারা জড়িত। প্রতিটি ঘটনায় তারা একই কাজ করেছে। প্রকৃত আসামি না ধরে, সুষ্ঠু তদন্ত না করে বিএনপির ওপর দোষ চাপাচ্ছে। বিএনপির মহাসচিব বলেন, হলফ করে বলতে পারি, তারেক রহমান, আবদুস সালাম পিন্টুসহ বিএনপির কোনো নেতাই এর সঙ্গে জড়িত ছিল না। কারণ যেকোনো হত্যাকা-ের একটি মোটিভ থাকে। সেই ঘটনায় বেনিফিশিয়ালি কে হয়েছে? আওয়ামী লীগ হয়েছে। আওয়ামী লীগ এটিকে ইস্যু করে বিএনপির বিরুদ্ধে কথা বলছে, বিএনপিকে ধ্বংস করছে। এ মামলার তদন্তভার সিআইডির অতিরিক্ত উপ মহা পুলিশ পরিদর্শক (অতিরিক্ত ডিআইজি) আবদুল কাহার আকন্দের ওপর ন্যস্ত করার পর মামলাটি ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করা হয়েছে’ বলে অভিযোগ করেন তিনি। বিএনপির শীর্ষস্থানীয় এ নেতা দাবি করেন, সঠিক তদন্ত যদি করা হতো, দোষীদের বের করার চেষ্টা করা হতো, তাহলে আসল সত্য বেরিয়ে আসত। রাজনৈতিকভাবে তারেক রহমানসহ বিএনপি নেতাদের যুক্ত করে এটাই প্রমাণিত হয়েছে সরকার রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে তাদের জড়িয়েছে। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মামলায় তারেক রহমানের নাম উঠে আসায় বিষয়টিকে ‘চক্রান্ত’ হিসেবে অভিহিত করে মির্জা ফখরুল বলেন, এই চক্রান্ত শুরু হয়েছে জিয়াউর রহমানকে হত্যার মধ্য দিয়ে। পরে এক-এগারোর পর থেকে আবার শুরু হয়েছে। বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদী দর্শনকে নির্মূল করে দিয়ে এবং তার ধারক-বাহক খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানকে রাজনৈতিকভাবে হেয় করে রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে রাখাই উদ্দেশ্য। এখন শুরু হয়েছে শারীরিকভাবে তাদের সরিয়ে দেওয়া। মিজা ফখরুল আরো বলেন, দীর্ঘদিন বলেছি, দেশনেত্রী খালেদা জিয়া খুবই অসুস্থ। তাঁকে ইউনাইটেড হাসপাতালে নিয়ে যান। তারা শোনে নাই। এখন কী হয়েছে? আজকে তিনি এত অসুস্থ হয়ে পড়েছেন যে তিনি পঙ্গু হয়ে পড়তে পারেন। সরকার আইন দিয়ে, শক্তি দিয়ে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে ফেলেছে মন্তব্য করে সাবেক এ মন্ত্রী বলেন, ফ্যাসিবাদ খুব খারাপ জিনিস। এটি মগজের মধ্যে ঢুকে যায়। তখন দেখা যায় সরকার যা চায়, জনগণ একটা সময় তাই করছে। পৃথিবীতে এমন দেশ আছে, যাদের নেতা হাসলে তারা হাসে, নেতা কাঁদলে তারা কাঁদে। আমাদের দেশে প্রায় একই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এখন নেতা হাসলে আমাদের লোকজন হাসতে থাকে, ওনার চোখে পানি এলে সবাই কাঁদতে থাকে। এটা শুরু হয়েছে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সরকারি চাকরিজীবীদের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা করা হচ্ছে উল্লেখ করে মির্জা ফখরুল বলেন, নির্বাচন নিয়ন্ত্রণ করতেই এটি করা হচ্ছে। কারণ এরা সরকারি চাকরিজীবী হওয়ায় কেউ-ই সরকারের কথার বাইরে যেতে পারবে না। বর্তমান সময়কে গভীর সংকটকাল অভিহিত করে বিএনপির মহাসচিব সবাইকে সরকারের আচরণের প্রতিবাদ করতে রাস্তায় নামার আহ্বান জানান। বলেন, সবাইকে বেরিয়ে এসে প্রতিবাদ করা দরকার। রাজপথে আসতে হবে, এর বিকল্প নেই। কেউ আপনাকে ক্ষমতায় বসিয়ে দেবে না, এই সরকারকে সরিয়ে দেবে না, যতক্ষণ না পর্যন্ত জনগণ সরিয়ে দিচ্ছে। আমাদের কাজ জনগণকে সংগঠিত করে উদ্বুদ্ধ করে রাজপথে নামা। কোনো শর্টকার্ট পদ্ধতি নেই। জনগণকে নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। কারণ জনগণের শক্তি ছাড়া শক্তিশালী কিছু নেই। পদত্যাগী প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার সাম্প্রতিক বক্তব্যের সূত্র ধরে ফখরুল বলেন, তিনিও বলেছেন, বাংলাদেশে এখন আইনের শাসন বলতে কিছু নেই। সবচেয়ে ভয়াবহভাবে আক্রান্ত হয়েছে লোয়ার জুডিশিয়ারি। কারণ সরকারের নিয়ন্ত্রণে এটি রয়েছে। তার ভাষায়, জনগণকে বাদ এখন সরকার নির্ভর করছে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ওপর। আজকের পত্রিকায় আছে, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারিদের পেনশন বাড়িয়ে দিয়েছে। শেখ হাসিনার এখন আর জনগণের প্রয়োজন নেই। আমলা-পুলিশ-আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী-বন্দুক পিস্তলধারী লোকজন, সরকারি লোকজন হলে তার চলে যায়। দেশ এখন গভীর সঙ্কটে পড়েছে মন্তব্য করে মির্জা ফখরুল বলেন, এখন মুখ বুঝে পড়ে না থেকে প্রতিবাদ করতে হবে। প্রতিবাদের ভাষাটা নিয়ে রাজপথে আসতে হবে- এর কোনো বিকল্প নাই। কেউ আপনাকে ক্ষমতায় বসিয়ে দিয়ে যাবে না, কেউ এই সরকারকে সরিয়ে দেবে না, যতক্ষণ পর্য্ন্ত না জনগণ সরিয়ে দিচ্ছে। এজন্য জনগণকে সংগঠিত করার আহ্বান জানিয়ে বিএনপি মহাসচিব বলেন, কোনো নির্দিষ্ট দল নয়, ব্যক্তি নয়, সমগ্র জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে এই ভয়াবহ ফ্যাসিস্ট শক্তিকে সরাতে হবে। আন্দোলন বলুন, নির্বাচন বলুন, মানুষের অধিকার বলুন- সব কিছু জনগণের শক্তির মধ্য দিয়ে আমরা অর্জন করতে পারি। বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও ডাকসুর সাবেক ভিপি আমানউল্লাহ আমানের সভাপতিত্বে এবং নির্বাহী কমিটির সদস্য নাজিম উদ্দিন আলমের সঞ্চালনায় স্মরণসভায় বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা হাবিবুর রহমান হাবিব, যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবীর খোকন, সাংগঠনিক সম্পাদক ফজলুল হক মিলন, প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানি, সমাজকল্যাণবিষয়ক সম্পাদক কামরুজ্জামান রতন বক্তব্য দেন।