আগামী সংসদ নির্বাচনেও সংস্কৃতিজগতের অনেকের নির্বাচন করার কথা শোনা যাচ্ছে। এঁদের কেউ সরকারি দলের হয়ে, অন্যরা বিএনপি ও জাতীয় পার্টি থেকে নির্বাচন করার কথা ভাবছেন। সংস্কৃতিকর্মীদের অনেকে নির্বাচনকে মাথায় রেখে বেশ কিছুদিন ধরে নিজের এলাকায় যাওয়া-আসা বাড়িয়েছেন। কথা বলছেন সেখানকার সব শ্রেণি–পেশার মানুষের সঙ্গে।আসাদুজ্জামান নূর, তারানা হালিম, মমতাজ—তাঁরা তিনজনই অভিনয় ও গান দিয়ে এ দেশের অজস্র দর্শক-শ্রোতার মন জয় করেছেন। জীবনের একটা পর্যায়ে এসে অংশ নিয়েছেন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে। নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকায় জয়ী হয়ে সাংসদও নির্বাচিত হয়েছেন আসাদুজ্জামান নূর ও মমতাজ। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের হয়ে গঠিত সরকারে সংস্কৃতিজগতের দুজন পেয়েছেন মন্ত্রিত্বও।
আসাদুজ্জামান নূর নীলফামারী-২ আসন থেকে ২০০১, ২০০৮ ও ২০১৪ সালে সাংসদ নির্বাচিত হন। এবারও তিনি এই আসন থেকে লড়বেন। ২০০৯ সালে নবম জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত নারী আসনে মানিকগঞ্জ–২ আসন থেকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাংসদ মনোনীত হন মমতাজ। ২০১৪ সালে এই আসন থেকে সাংসদ নির্বাচিত হন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী থাকা অবস্থায় যুবলীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক নির্বাচিত হন তারানা হালিম। পরবর্তী সময়ে পর্যায়ক্রমে বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোটের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন এবং বর্তমানে একই সংগঠনের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি।
২০০৯ ও ২০১৪ সালে জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত আসনে সাংসদ হিসেবে নির্বাচিত হন তারানা হালিম। এবার টাঙ্গাইল-৬ আসন থেকে সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে চান তিনি। এরই মধ্যে তিনি মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন।
চলচ্চিত্রের বরেণ্য অভিনেতা আকবর হোসেন পাঠান ফারুক অনেক দিন অভিনয় থেকে দূরে আছেন। ব্যবসা নিয়ে নিজেকে ব্যস্ত রেখেছেন। অভিনয় না করলেও চলচ্চিত্রের নানা সংকট সময়ে ফারুককে পাওয়া গেছে। অনিয়মেও সোচ্চার ছিলেন তিনি। অভিনয়ের পাশাপাশি আওয়ামী লীগের বিভিন্ন কর্মসূচিতেও তাঁর উপস্থিতিতে সব সময় চোখে পড়েছে। দেশের চলচ্চিত্রের গুণী এই অভিনেতা এবার সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার ব্যাপারে অনেক সরব। একাদশ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের পক্ষ হয়ে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার কথা জানিয়েছেন এই অভিনেতা। স্কুলজীবন থেকেই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ফারুক। ছয় দফা আন্দোলনের পর মুক্তিযুদ্ধেও অংশ গ্রহণ করেছেন তিনি। আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়নপ্রত্যাশী ফারুক জানান, নির্বাচনকে সামনে রেখে অনেক আগে থেকেই গাজীপুরের কালীগঞ্জে তিনি প্রচার–প্রচারণা শুরু করেছেন। তবে বাংলাদেশের যেকোনো জায়গায় তাঁর জনপ্রিয়তা সমান রয়েছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
ফারুকের নিজের নির্বাচনী এলাকা গাজীপুর-৫, তথা কালিগঞ্জ। এই আসন থেকেই তিনি নির্বাচন করতে চান। ফারুক বলেন, ‘এটা আমার বাপ–দাদার এলাকা। ৪০০ বছর ধরে এখানে আমাদের বসবাস। ঈশা খাঁ, ভাওয়াল ও পাঠান থেকে আমাদের পরিবার বের হয়ে এসেছে। এখানে আমার দাদাভাই থেকে শুরু করে প্রায় সবাই রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত, কিন্তু কেউই সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে চাইতেন না।’
কালিগঞ্জে নির্বাচনী প্রচারণা নিয়ে জানতে চাইলে ফারুক বলেন, ‘নেত্রী যদি আমাকে এই মুহূর্তে বলেন, তুই কালিগঞ্জে যা, তাহলে এক ঘণ্টার মধ্যে সেখানে লক্ষাধিক লোক জড়ো হয়ে যাবে। সেখানে যে গ্রহণযোগ্যতা আমার আছে, সেটা অনেক বড় ভালোবাসার জায়গা। শুধু কালিগঞ্জ কেন, আমি তো বলতে পারি নিজের এলাকা ছাড়াও বাংলাদেশের দশ জায়গা থেকে নির্বাচন করলেও আমি সফলতা পাব। মানুষ আমাকে ভালোবাসে। এই ভালোবাসা কল্পনার অতীত। তবে কালিগঞ্জে নির্বাচনকে সামনে রেখে আমি কাজ করছি।’
জাতীয়তাবাদী আদর্শে অনুপ্রাণিত ব্ল্যাক ডায়মন্ডখ্যাত গায়িকা বেবী নাজনীন। নীলফামারী-৪ (সৈয়দপুর-কিশোরগঞ্জ) আসনে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী জনপ্রিয় এই কণ্ঠশিল্পী। বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে বেশ সোচ্চার তিনি। ওই সংসদীয় এলাকার প্রতিটি হাটবাজার, পথেঘাটে শোভা পাচ্ছে তাঁর পক্ষে রঙিন পোস্টার, ব্যানার, ফেস্টুন ও বিলবোর্ড। বিএনপির কেন্দ্রীয় আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক বেবী নাজনীন সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশে এসেছেন। নির্বাচনী ভাবনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এই মুহূর্তে আমাদের প্রধান দাবি খালেদা জিয়ার নিঃশর্ত মুক্তি। এ জন্য দেশে ও বিদেশে ব্যাপক জনমত গড়তে কাজ করে যাচ্ছি আমরা। তবে দল নির্বাচনে গেলে আমি মনোনয়ন চাইব। স্থানীয় বিএনপি আমার পক্ষে জনসংযোগ শুরু করেছে। সাধারণ লোকজনও এতে অংশ নিচ্ছেন। তাঁরাই এসব পোস্টার, ফেস্টুন ও ব্যানার লাগাচ্ছেন। আর আমার জন্মস্থান সৈয়দপুর। সে কারণে ওই এলাকায় কাজ করাটা আমার নৈতিক দায়িত্ব।’
অভিনয়ের পাশাপাশি বিভিন্ন সময় নানা ইস্যুতে রাজপথে সোচ্চার দেখা গেছে রোকেয়া প্রাচীকে। ২০১৪ সালে সংরক্ষিত নারী আসনের জন্য মনোনয়ন চেয়েছিলেন। কিন্তু পাননি। এবার সরাসরি সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার জোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন তিনি। তিন বছর ধরে ফেনী–৩ আসনের নানা জায়গায় মানুষের সঙ্গে কথা বলেছেন। অংশ নিয়েছেন আওয়ামী লীগের বিভিন্ন কর্মসূচিতে। সাংগঠনিকভাবে তিনি বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রসঙ্গে জানতে চাইলে রোকেয়া প্রাচী প্রথম আলোকে বলেন, ‘তিন বছর ধরে নির্বাচনী এলাকায় কাজ করছি। প্রথম থেকে আত্মবিশ্বাসী ছিলাম নির্বাচন করার জন্য, এটা সবাই জানেনও। ২০১৪ সালে তো সংরক্ষিত নারী আসনের জন্য মনোনয়ন চেয়েছিলাম। তখন আসলে রাজপথের যে দক্ষতা, নির্বাচনের কনফিডেন্ট তা আমার ছিল না। এবার অবশ্য আমি মানসিক ও রাজনৈতিকভাবে পুরোপুরি তৈরি, সিদ্ধান্তও নিয়ে রেখেছি নির্বাচন করার। এখন দল যদি আমাকে মনোনয়ন দেয়, তাহলে নির্বাচনে প্রার্থী হব।’
রোকেয়া প্রাচী মনে করেন, সংসদ নির্বাচনে তৃণমূলের মানুষের সমর্থন খুবই জরুরি, যা তিনি অর্জন করেছেন বলেও মনে করছেন। রোকেয়া প্রাচী বলেন, ‘এ কথা অস্বীকার করার কোনো অবকাশ নেই, নির্বাচনে তৃণমূলের মানুষই মূল শক্তি। তাই তো এত বছর ধরে তাদের জন্য কাজ করেছি।’
ফেনী–৩ আসন থেকে নির্বাচন করার কথা শোনা যাচ্ছে আশি ও নব্বই দশকের জনপ্রিয় অভিনয়শিল্পী শমী কায়সারকে। এলাকার বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে তাঁর সরব উপস্থিতি তেমনটাই ইঙ্গিত করছে বলে সাংস্কৃতিক অঙ্গনের অনেকের অভিমত। সম্প্রতি প্রথম আলোর সঙ্গে শমী কায়সারের কথা হয়। তিনি তখনো ফেনীতে নির্বাচনী প্রচারণার কাজে ব্যস্ত। শমী বলেন, ‘আমাদের পুরো পরিবার, আমার মা সারা জীবনই এলাকার জন্য কাজ করে। সোনাগাজী ও দাগনভূঞা নিয়ে ফেনী–৩ আসন। এই আসন নৌকার জন্য অনেক চ্যালেঞ্জিং একটা জায়গা। আমার নিজের এমপি হওয়ার চেয়ে, বিশেষ করে এলাকার উন্নয়নে, নৌকার জয়ের জন্য কাজ করাটাই প্রধান লক্ষ্য। আমার বাপ-দাদার স্মৃতিবিজড়িত এই এলাকা। এখানে জহির রায়হান ও শহীদুল্লা কায়সারের নামে একটা পাঠাগার করছি, কমপ্লেক্স করছি। সেই সুবাদে এখানে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, নৌকা, বঙ্গবন্ধু এবং জননেত্রী শেখ হাসিনার জন্য কাজ করাই আসল উদ্দেশ্য। এখানে আমি মনোনয়ন পেলাম, এমপি হলাম, নাকি মন্ত্রী হলাম, এসব নিয়ে কোনো চিন্তাভাবনা নেই।’
শমী কায়সার বলেন, ‘আমাদের পরিবারের সবাই সব সময় বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় কাজ করেছি। উন্নয়নের ধরে রাখার জন্য নৌকার পক্ষে মানুষের কাছে ভোট চাওয়া, শেখ হাসিনার জন্য ভোট চাওয়া দায়িত্বের জায়গা থেকে করছি। এটাই আমার বড় এজেন্ডা। আমার পরিবারেরও সেই এজেন্ডা ছিল, মায়েরও ছিল। আমারও তাই। জননেত্রী শেখ হাসিনা যাঁকেই মনোনয়ন দিয়ে পাঠাবেন, এই উন্নয়ন ধরে রাখার জন্য তাঁর জন্য কাজ করব। আমি কাজ করতে চাই। আর তিনি যদি আমাকে যোগ্য মনে করেন, তাহলে অবশ্যই করব। শহীদুল্লা কায়সার ও জহির রায়হানের বংশধর হিসেবে এখানকার মানুষের আলাদা একটা আবেগ আমার প্রতি কাজ করে। এটা আমার খুব ভালো লাগে।’
‘হঠাৎ বৃষ্টি’ সিনেমায় অভিনয় করে সবাইকে চমকে দেন চিত্রনায়ক ফেরদৌস। ২০ বছর বাংলাদেশ ও ভারতে অসংখ্য ছবিতে অভিনয় করে প্রশংসিত হয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে পাস করা ফেরদৌস আহমেদ। ছবি প্রযোজনাও নাম লিখিয়েছেন এই নায়ক। কিছুদিন ধরে ঢালিউডের বাতাসে জোর গুঞ্জন, চিত্রনায়ক ফেরদৌস সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হতে যাচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাঁকে নিয়মিত দেখাও যাচ্ছে। যাঁকে নিয়ে এত ভাবনাচিন্তা, সেই ফেরদৌস কী বলেন? প্রথম আলোকে ফেরদৌস বলেন, ‘আমি আসলে কিছু ভেবে কোথাও যাচ্ছি না। নির্বাচন করতেই হবে—এমন কোনো চিন্তা আমার মনের মধ্যে নেই। আমি যেসব অনুষ্ঠানে যাচ্ছি, তা একান্তই নিজের ভালো লাগা থেকে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাদের যে সম্মান দিয়েছেন, অবশ্যই তাঁর উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের সঙ্গে থাকতে চাই। তাঁর কার্যক্রমের সঙ্গে থাকতে আমার ভালো লাগে। জাতিসংঘের অধিবেশনে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার পর আমি তাঁকে খুব কাছ থেকে দেখেছি। দেশ ও দেশের মানুষের জন্য তাঁর যে ডেডিকেশন, ডিভোশন ও ভালোবাসা, এটা আমাকে খুব স্পর্শ করেছে। তাই তো প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যেসব অনুষ্ঠানে আমাকে ডাকা হচ্ছে, সেখানে যাচ্ছি। আমি সত্যিই সম্মানিতবোধ করেছি।’
নির্বাচন করবেন কি না—সরাসরি জানতে চাইলে ফেরদৌস বলেন, ‘নির্বাচন করতেই হবে, তেমন কিছু মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে না। তবে যদি কখনো সময়ের সঙ্গে যায়, সেটা সময়ই বলে দেবে। প্রধানমন্ত্রী যদি আমাকে নিয়ে ভাবেন, সেটাকে অবশ্যই মাথা পেতে নেব। তিনি যদি আমাকে কোথাওর জন্য যোগ্য মনে করেন, সেখানেই করব। মোট কথা, বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর যে উন্নয়ন অগ্রযাত্রা, সেটার সঙ্গে যেকোনোভাবেই আমার থাকার ইচ্ছে।’
(প্রথম আলো )