হুইলচেয়ারে করে আদালতে হাজির খালেদা জিয়া, নাইকো দুর্নীতি মামলার শুনানি ৩রা জানুয়ারি

561

বিএনপির চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে নাইকো দুর্নীতি মামলায় অভিযোগ গঠনের ওপর শুনানির জন্য আগামী বছরের ৩রা জানুয়ারি দিন ধার্য করেছেন আদালত। এ মামলার অন্যতম আসামি বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের অব্যাহতির আবেদনের ওপর গতকাল আংশিক শুনানি নিয়ে ঢাকার নবম বিশেষ জজ আদালতের বিচারক মো. মাহমুদুল কবির এ দিন ধার্য করেন। রাজধানীর নাজিমউদ্দিন রোডের পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারের ভেতরের একটি ভবনে স্থাপিত অস্থায়ী বিশেষ এজলাসে এ মামলার কার্যক্রম চলছে। দুটি মামলায় ১০ ও ৭ বছরের কারাদণ্ডপ্রাপ্ত খালেদা জিয়াকে রাখা হয়েছে পরিত্যক্ত ওই কারাগারের আরেকটি ভবনে। নাইকো মামলায় গতকাল খালেদা জিয়াকে হুইলচেয়ারে করে আদালতে হাজির করা হয়।

এ সময় নির্বাচনের কারণ দেখিয়ে শুনানি পেছানোর আর্জি জানান খালেদা জিয়া। আদালতের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘একপক্ষ নির্বাচনে কাজ করছে আর আমাদেরকে আদালতে আসতে হচ্ছে। যদি আমাদেরকে আদালতেই আটকে রাখা হয় তাহলে বলে দিক আমাদের নির্বাচনে যাওয়ার প্রয়োজন নেই’- আদালতের পরিবেশ ও নিরাপত্তার কড়াকড়ি নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করে খালেদা জিয়া একথা বলেন। তিনি বলেন, ‘বহু গুরুত্বপূর্ণ মামলা রয়েছে।

গতকাল শুনানির অনেকটা সময়জুড়ে নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া নিয়ে বাহাস ও একে অপরের উদ্দেশ্যে টিপ্পনী কাটেন উভয়পক্ষের আইনজীবীরা। এমনকি বিএনপির চেয়ারপারসনও দুদক আইনজীবীর উদ্দেশ্যে টিপ্পনী কাটেন। নির্বাচনী কার্যক্রমে ব্যস্ত থাকবেন- এমন যুক্তি দেখিয়ে আসামিপক্ষ শুনানি পেছানোর আবেদন করলে প্রসিকিউশনপক্ষ তাতে আপত্তি জানান। দুপুর ১২টা বাজার কিছুক্ষণ আগে খালেদা জিয়াকে আদালতের এজলাসে আনা হয়। হালকা নীল শাড়ি পরিহিত খালেদা জিয়া হুইলচেয়ারে বসে প্রায় সোয়া এক ঘণ্টা আদালতে অবস্থান করেন।

১২টার কিছু পরে আদালতের কার্যক্রম শুরু হলে খালেদা জিয়ার আইনজীবী মাসুদ আহমদ তালুকদার বলেন, এখানে নিরাপত্তার কড়াকড়ি রয়েছে। সিনিয়র আইনজীবীদের দাঁড়ানোর কোনো জায়গা নেই। আদালতে স্থান সংকুলানের বিষয়টি নিয়ে বিচারকের হস্তক্ষেপ কামনা করেন তিনি।

আইনজীবী মওদুদ আহমদ বলেন, ‘বিচারকাজ চলার মতো আদালতের কোনো পরিবেশ এখানে নেই। আপনি (বিচারক) কি কোনোদিন আদালতে এ ধরনের পরিবেশ দেখেছেন। আমাদের যত খুশি সাজা দেন, ফাঁসি দেন, বিচারকাজের যে ন্যূনতম পরিবেশ সেটি বজায় রাখেন।’ তিনি বলেন, ‘সংবিধানের ৩৫ অনুচ্ছেদে মৌলিক অধিকারের কথা বলা আছে। জেলখানার ভেতরে আদালত বসিয়ে কোনো পাবলিক ট্রায়াল হতে পারে না। এটা তো কোনো হাই সিকিউরিটি মামলা নয়। আপনি আদালতের এই পরিবেশের বিষয়টি কর্তৃপক্ষের নজরে আনবেন।

একপর্যায়ে খালেদা জিয়াও আদালতের পরিবেশ নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করে বলেন, ‘এই একসময় ওই আদালতে (মহানগর দায়রা আদালত) গিয়েছিলাম। সেখানেই তো বিচার চলছিল। এখানে বিচারের কারণ কি? কারাগারের ভেতরে বিচার হয় কীভাবে? আমার আইনজীবীরা বসতে পারছেন না। এভাবে বিচারকাজ চলতে পারে না।’ আদালতের ভেতরে নিরাপত্তার কড়াকড়ি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘পুলিশ আদালতে সিকিউরিটি দেবে। কিন্তু পুলিশ এত কাছাকাছি অবস্থান নেয় কেন? আদালতে এত বেশি সিকিউরিটি কেন দরকার? আমি তো আইনজীবীদের দেখছি না।’ খালেদা জিয়া আরো বলেন, ‘আমাদের মামলাগুলো কেন দ্রুত বিচার হচ্ছে। বহু গুরুত্বপূর্ণ মামলা রয়েছে। এর আগে দ্রুত বিচার কয়টা হয়েছে? নারায়ণগঞ্জের সেভেন মার্ডার মামলায় তো দ্রুত বিচার হয়নি। কিন্তু কিসের জন্য আমাদের মামলাগুলো দ্রুত বিচার হচ্ছে?’ একপর্যায়ে বিচারক এজলাসের সমস্যাগুলোর বিষয়ে প্রসিকিউশনকে অবহিত করবেন বলে জানান।

এ সময় মওদুদ আহমদ ইসির সঙ্গে তার বৈঠক ও আগামী নির্বাচনের প্রসঙ্গ টেনে শুনানি মুলতবির আবেদন জানালে তাতে আপত্তি জানান দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল। তিনি বলেন, ‘আজকে উনার (মওদুদ আহমদ) বক্তব্য শুনেই মনে হচ্ছে উনি মামলা না করার জন্যই এসেছেন। কিন্তু এই মামলার সঙ্গে নির্বাচনের কোনো সম্পর্ক নেই। নির্বাচন রাজনীতির ময়দানে থাকুক। রাজনীতির সঙ্গে আদালতের কোনো সম্পর্ক নেই।’

এসময় খালেদা জিয়া দুদক আইনজীবীর উদ্দেশ্যে বলেন, ‘রাজনীতির সঙ্গে আদালতের সম্পর্ক নেই- এ কথাটি ঠিক নয়। রাজনীতির সঙ্গে সবকিছুর সম্পর্ক আছে।’ তিনি বলেন, ‘যেহেতু এখন সবাই মাঠে কাজ (নির্বাচনী কার্যক্রম) করছে, কেউ আমার জন্য, কেউ তাদের জন্য, যেখানে নির্বাচন নিয়ে সবাই ব্যস্ত সেখানে আমাদের কোর্টে আটকে রাখা হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘একপক্ষ নির্বাচনে কাজ করছে আর আমাদেরকে আদালতে আসতে হচ্ছে। অনেক প্রতিবন্ধকতার মধ্যে আমাদের কাজ (নির্বাচনী কার্যক্রম) করতে হচ্ছে। তারপরেও যদি আমাদের কোর্টেই আটকে রাখা হয়, তাহলে বলে দিক আমাদের নির্বাচনে যাওয়ার প্রয়োজন নেই।’

একপর্যায়ে প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা মামলা সংক্রান্ত বক্তব্য আদালতে উপস্থাপন করে শুনানি মুলতবি চান মওদুদ আহমদ। তিনি বলেন, আমাদের সংবিধানেও আছে নির্বাচনের সময় সবাই সহযোগিতা করবেন। এর অর্থ যাতে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন হয়।

এ সময় মোশাররফ হোসেন কাজল বলেন, ‘উনার (মওদুদ) পক্ষে যদি আইনজীবী নিয়োগ দেয়া হয়, তাহলে কোনো কথা নেই। কিন্তু উনি নির্বাচনও করবেন আবার মামলাও করবেন- এটা তো হয় না।’
বিচারক বলেন, ‘আপনার বক্তব্যের প্রেক্ষিতে আমরা মুলতবি দিতে পারি। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে আপনি ধার্য তারিখেও আপনার বক্তব্য শেষ করতে পারবেন না।’

এক পর্যায়ে খালেদা জিয়ার আইনজীবী মাসুদ আহমেদ তালুকদার দুদকের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজলকে উদ্দেশ্য করে টিপ্পনী কেটে বলেন, ‘উনি আমাদের অনেক নির্যাতন করেছেন। আমরা উনার হাত থেকে বাঁচতে চাই। উনি নৌকা মার্কায় ভোট করার জন্য মনোনয়নপত্র কিনেছেন। উনি এমপি হয়ে এখান থেকে বিদায় নিলে আমরা বাঁচি। তার একথায় খালেদা জিয়াসহ উপস্থিত সবাই হেসে উঠেন।’ মাসুদ আহমেদ তালুকদার আরো বলেন, ‘দুদকের এর আগের চিফ প্রসিকিউটর (বর্তমান আইনমন্ত্রী আনিসুল হক) আইনমন্ত্রী হয়েছেন। আশা করি নির্বাচনে জিতে উনিও (মোশাররফ হোসেন কাজল) আইন প্রতিমন্ত্রী হবেন।

শুনানির একপর্যায়ে খালেদা জিয়া দুদক আইনজীবীর উদ্দেশ্যে হাস্যোচ্ছলে বলেন, ‘কাজল সাহেব (মোশাররফ হোসেন কাজল) আপনি তো পূর্ণ মন্ত্রী হয়ে যাবেন। জবাবে দুদক আইনজীবী বলেন, ‘ম্যাডাম আমাকে দোয়া করবেন।’
দুপুর ১টার দিকে আদালতে আসেন খালেদা জিয়ার অন্যতম আইনজীবী জয়নুল আবেদীন ও মাহবুব উদ্দিন খোকন। এসময় জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘আমরা একটি সৌহার্দ্যপূর্ণ অবস্থার মধ্যে আছি। আদালতও মনে করে দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা দরকার। এই অবস্থায় সবাইকে সুযোগ দেয়া উচিত।’ একপর্যায়ে খালেদা জিয়া শুনানি পেছাতে আদালতের উদ্দেশে বলেন, ‘যেহেতু সামনে নির্বাচন, সবাই নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত। সকলেই যে যার এলাকায় চলে যাবে। আদালতে কেউ আসতে পারবে না। আদালতে আসা আমার জন্য কষ্টকর হয়ে যায়। আপনি দেড় মাস সময় দিন। এ ছাড়া সম্ভব নয়।’ উভয়পক্ষের বক্তব্য শুনে বিচারক পরবর্তী শুনানির জন্য আগামী ৩রা জানুয়ারি দিন ধার্য রাখেন। আদালতের কার্যক্রম শেষ হওয়ার একটু পরই এজলাসের একটি পাশের কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয় খালেদা জিয়াকে। সেখানে গিয়ে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন, ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন ও অ্যাডভোকেট আহমেদ আজম খান। তবে, খালেদা জিয়ার সঙ্গে কি বিষয়ে কথা হয়েছে সেটি সাংবাদিকরা জানতে চাইলে মওদুদ আহমদ কোনো কথা বলতে রাজি হননি।

মামলার নথিপত্র অনুযায়ী ক্ষমতার অপব্যবহার করে তিনটি গ্যাসক্ষেত্র পরিত্যক্ত দেখিয়ে কানাডীয় কোম্পানি নাইকোর হাতে তুলে দিয়ে রাষ্ট্রের প্রায় ১৩ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকার ক্ষতির অভিযোগে ২০০৭ সালের ৯ই ডিসেম্বর রাজধানীর তেজগাঁও থানায় এ মামলা দায়ের করে দুদক। খালেদা জিয়া ও মওদুদ আহমদ ছাড়া মামলার অন্য আসামিরা হলেন- সাবেক প্রতিমন্ত্রী একেএম মোশাররফ হোসেন, সাবেক মুখ্য সচিব কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী, সাবেক সচিব খন্দকার শহীদুল ইসলাম, সাবেক জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব সি এম ইউছুফ হোসাইন, বাপেক্সের সাবেক মহাব্যবস্থাপক মীর ময়নুল হক, বাপেক্সের সাবেক সচিব মো. শফিউর রহমান, ব্যবসায়ী গিয়াস উদ্দিন আল মামুন, ঢাকা ক্লাবের সাবেক সভাপতি সেলিম ভূঁইয়া এবং নাইকোর দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক ভাইস প্রেসিডেন্ট কাশেম শরীফ।