নয়াপল্টন কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে বিএনপির নেতাকর্মীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ ও আগুনের ঘটনায় করা তিন মামলায় দলের মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করতে আসা পাঁচজনসহ ৩৮ জনকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
আজ শনিবার ঢাকা মহানগর হাকিম মাইনুল ইসলাম রিমান্ড শেষে তাদের কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
পল্টন থানার আদালতের সাধারণ নিবন্ধন কর্মকর্তা জালাল উদ্দিন বিষয়টি জাগো নিউজকে নিশ্চিত করে বলেন, এই ৩৮ জনকে পাঁচদিনের রিমান্ড দেয়া হয়েছিল। দুই দিনে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ শেষ হওয়ায় তাদের কারাগারে পাঠানোর আবেদন করেন তদন্তকারী কর্মকর্তা। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত তাদের কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
এর আগে বৃহস্পতিবার (১৫ নভেম্বর) ৬৫ জনকে আদালতে হাজির করে পুলিশ। এ সময় মামলার সুষ্ঠু তদন্তের জন্য পৃথক তিন মামলায় তাদের বিভিন্ন মেয়াদে রিমান্ড আবেদন করেন তদন্তকারী কর্মকর্তা। শুনানি শেষে ঢাকা মহানগর হাকিম সরাফুজ্জামান আনছারী ৩৮ জনের পাঁচদিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন। বাকি ২৭ জনের রিমান্ড নামঞ্জুর করে জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদের নির্দেশ দেন।
৩৮ জনের মধ্যে তরিকুল ইসলাম, জাহাঙ্গীর হোসেন, আবু বক্কর সিদ্দিক ও হেলাল উদ্দিনসহ পাঁচজন বিভিন্ন জেলা থেকে ঢাকায় মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করতে আসেন। আর বাকি আসামিরা বিএনপির সমর্থক বলে জাগো নিউজকে জানিয়েছেন বিএনপি সহ আইনবিষয়ক সম্পাদক জয়নুল আবেদীন মেজবাহ।
বুধবার রাতে নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে বিএনপি নেতাকর্মীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ ও আগুনের ঘটনায় করা তিন মামলায় মির্জা আব্বাসসহ ছয় নেতাকে হুকুমের আসামি করে মামলা করে পুলিশ।
অপর পাঁচ নেতা হলেন- জাতীয়তাবাদী মহিলা দলের সভাপতি আফরোজা আব্বাস, বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, যাত্রাবাড়ী বিএনপির সভাপতি নবীউল্লাহ নবী, ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) আকতারুজ্জামান এবং চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কফিল উদ্দিন।
পুলিশের অভিযোগ, তাদের মদদে ও নির্দেশে পুলিশের ওপর হামলা চালিয়ে সরকারি কাজে বাধা, জানমালের ক্ষতি, ককটেল বিস্ফোরণ ও গাড়ি পুড়িয়ে আতঙ্ক ছড়ানো হয়। ইতোমধ্যে মামলা তিনটি ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
মামলায় অন্য আসামিরা হলেন বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রশিদ হাবিব, মিডিয়া উইং সামসুদ্দিন দিদার, দফতর সম্পাদক বেলাল আহমেদ, নির্বাহী কমিটির সদস্য অধ্যাপক আমিনুল ইসলাম, অ্যাডভোকেট নিপুণ রায়, যুবদলের সভাপতি রফিকুল ইসলাম মজনু, ছাত্রদল ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি জহির উদ্দিন তুহিন, কেন্দ্রীয় সহ-সাধারণ সম্পাদক আরিফা সুলতানা রুমাসি আরও অনেকে।
বুধবার (১৪ নভেম্বর) রাতে ২১নং মামলাটি করা হয় বিস্ফোরক ও বাংলাদেশ দণ্ডবিধি আইনে। ১৯২ জনের নাম উল্লেখ ও অজ্ঞাত সহস্রাধিক বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীকে ওই মামলায় আসামি করা হয়েছে। ওই মামলায় ইতোমধ্যে ১৬ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
বিশেষ আইনে করা ২২নং মামলায় আসামি করা হয়েছে ১৫৯ জনকে। এ মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছে ২৩ জনকে এবং বাংলাদেশ দণ্ডবিধি আইনে করা ২৩নং মামলায় ১৩৭ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এ মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়েছে ২৬ জনকে।
২১নং মামলার বাদী পল্টন থানার এসআই সোমেন কুমার বড়ুয়া। মামলার এজহারে বলা হয়, নির্বাচনী আচরণ বিধির নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও প্রথমে জাতীয়তাবাদী মহিলা দলের সভাপতি আফরোজা আব্বাসের নেতৃত্বে ব্যান্ডপার্টি ব্যানার-ফেস্টুনসহ শোডাউন নিয়ে বিএনপির পল্টন কার্যালয়ে আসে।
এরপর নবীউল্লাহ নবী ও কফিল উদ্দিনের নেতৃত্বে পৃথক মিছিল শোডাউন নিয়ে আসে। পরে মির্জা আব্বাসের নেতৃত্বে ৮-১০ হাজার নেতাকর্মী নিয়ে মিছিল সহকারে কার্যালয়ে আসে। তারা নয়াপল্টনের ভিআইপি সড়ক বন্ধ করে মিছিল ও শোডাউনের মাধ্যমে জনদুর্ভোগ তৈরি ও যানচলাচল বন্ধ করে। তাদের রাস্তার এক লেন ছেড়ে দিতে অনুরোধ করা হলে তারা ক্ষিপ্ত হয়। আচরণ বিধি লঙ্ঘনের বিষয়টি রুহুল কবির রিজভীকেও জানানো হয়। মাইকেও বলা হয়। এরপর দুপুর ১২টা ৫৫ মিনিটে মির্জা আব্বাসের নেতৃত্বে কার্যালয়ের পাশের সড়কে অবস্থান নেয়। তাদের পার্টি অফিস থেকে লাঠিসোটা নিয়ে রাস্তায় দাঙা করে পুলিশকে হত্যার উদ্দেশ্যে ইচ্ছাকৃতভাবে আক্রমণ ও ককটেল বিস্ফোরণ ঘটায়। গাড়িতে আগুন দেয়া হয়। প্রায় একই ধরনের অভিযোগ বাকি দুই মামলার এজহারেও উল্লেখ করা হয়েছে।
তবে ২২নং মামলায় উল্লেখ করা হয়, ১-৬ নং আসামিসহ পার্টি অফিসে উপস্থিত অন্যান্য কেন্দ্রীয় নেতাদের প্রত্যক্ষ মদদ, নির্দেশ ও অর্থায়নে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন বানচাল ও দেশে অস্থিতিশীল এবং নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি তৈরির অসৎ ও অভিন্ন উদ্দেশ্যে মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে রাস্তায় দাঙা করে পুলিশকে হত্যার উদ্দেশ্যে ইচ্ছাকৃতভাবে আক্রমণ, সরকারি কাজে বাধা, লাঠিসোটা ও ইটপাটকেল দিয়ে পুলিশকে আক্রমণ করে মারাত্মক জখম, পুলিশের যানবাহন পুড়িয়ে কার্যক্ষমতা ব্যাহতের চেষ্টা করা হয়।
২৩নং মামলায় উল্লেখ করা হয়, তাৎক্ষণিকভাবে গ্রেফতারকৃতরা স্বীকার করে যে, তারা ওই ছয়জনসহ কেন্দ্রীয় নেতাদের নির্দেশে ও মদদে পলাতক এজহার নামীয় আসামিসহ আরও অনেককে নিয়ে পুলিশের মনোবল ভেঙে আসন্ন সংসদ নির্বাচন বানচাল এবং অস্থিতিশীল ও নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি তৈরির অসৎ ও অভিন্ন উদ্দেশ্যে এসব ঘটনা ঘটানো হয়।
আসামিদের নিক্ষিপ্ত ইটের আঘাতে মতিঝিল বিভাগের এডিসি শিবলি নোমান, পল্টন জোনের সহকারী কমিশনার মিশু বিশ্বাস, পল্টন থানার ইন্সপেক্টর (অপারেশন) আবু সিদ্দিকসহ ২৩ সদস্য আহত হন।
এর আগে বৃহস্পতিবার দুপুরে পুলিশের ওপর হামলাকে ‘নগ্ন ও পৈচাশিক’ বলে উল্লেখ করে ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া বলেন, অসৎ উদ্দেশ্যে একটি ইস্যু তৈরির জন্য এ হামলা হয়েছে। তারা উদ্দেশমূলকভাবে হামলা চালিয়ে জনজীবনকে দুর্বিষহ, জননিরাপত্তা বিঘ্নিত ও ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য এ ধরনের নগ্ন ও পৈচাশিক হামলা করেছে। অবশ্যই তাদের বিচারের আওতায় আনা হবে।
তিনি বলেন, এটি শুধুমাত্র পুলিশের ওপর হামলা না। এটি বড় ধরনের একটি হামলার পূর্বপরিকল্পনা মনে হয়েছে। ঘটনা পর্যালোচনা করে ইতোমধ্যে মামলা গ্রহণ করা হয়েছে। ঘটনাস্থল থেকে ৬০ জনকে চিহ্নিত করে গ্রেফতার করা হয়েছে। বাকিদের শনাক্তের কাজ চলছে।
হামলাকারীদের বিষয়ে কমিশনার বলেন, যারা অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর করেছে তাদের শনাক্ত করা হয়েছে। তারা সবাই বিএনপি ও তার অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মী।
উল্লেখ্য, দলীয় মনোনয়নপত্র সংগ্রহের মধ্যেই বুধবার (১৪ নভেম্বর) নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে পুলিশের সঙ্গে বিএনপির নেতাকর্মীদের সংঘর্ষ হয়। এতে পুলিশের একটি পিকআপ ভ্যানসহ দুটি গাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হয়।