দুর্নীতির দুই মামলায় দণ্ডিত কারাগারে থাকা বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার জন্য তিনটি আসনে মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করা হয়েছে। প্রশ্ন দেখা দিয়েছিল, দণ্ডিত খালেদা জিয়া কি একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন?
আজ মঙ্গলবার বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি কে এম হাফিজুল আলমের হাইকোর্ট বেঞ্চের এক আদেশের পর নিম্ন আদালতে সাজাপ্রাপ্ত বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ভোটে অংশগ্রহণের পথ অনেকটাই আটকে গেল।
অবশ্য নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সরকারের দুজন আইন কর্মকর্তা বলেছেন, একটা পথ অবশ্য আছে। সেটা হলো আপিল বিভাগ থেকে যদি খালেদা জিয়া ভোটে অংশ নেওয়ার ব্যাপারে দিকনির্দেশনা পান। কিন্তু সে জন্য তাঁর হাতে সময় খুবই কম। পাশাপাশি এই রায়ের ফলে শুধু খালেদা জিয়াই নন, প্রার্থী হিসেবে অযোগ্য হবেন সব দলের সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা, যাঁদের সাজা-দণ্ড স্থগিত হয়নি।
আজ হাইকোর্ট বলেছেন, নিম্ন আদালতে দুই বছরের বেশি সাজা হলে আপিল বিচারাধীন থাকা অবস্থায় কোনো ব্যক্তি নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না। দুর্নীতির দায়ে বিচারিক আদালতের দেওয়া দণ্ড ও সাজা ভোগ স্থগিত চেয়ে বিএনপির পাঁচ নেতার করা আবেদন খারিজ করে দেওয়া রায়ে আদালত এ কথা বলেন।
আদালত আদেশে বলছেন, সংবিধানের ৬৬(২)(ঘ) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কারও দুই বছরের বেশি সাজা বা দণ্ড হলে সেই দণ্ড বা সাজার বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল বিচারাধীন থাকা অবস্থায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। অবশ্য যতক্ষণ না আপিল বিভাগ ওই রায় বাতিল বা স্থগিত করে তাঁকে জামিন দেন।
বিএনপির চেয়ারপারসন দুটি দুর্নীতি মামলায় ১৭ বছরের কারাদণ্ড ভোগ করছেন। জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় নিম্ন আদালতের রায় স্থগিত, সাজা ভোগ বাতিল ও জামিন চেয়ে উচ্চ আদালতে আপিল করেছেন। আর জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় উচ্চ আদালত সাজা বাড়িয়ে ১০ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল অনুযায়ী মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন আগামীকাল বুধবার। মনোনয়নপত্র বৈধ না অবৈধ, তা জানা যাবে আগামী ২ ডিসেম্বর। এরপর নির্বাচন কমিশন ও উচ্চ আদালতে মনোনয়নপত্র বৈধতা নিয়ে আপিল করা যাবে। তবে সে জন্য আপিল বিভাগে খালেদা জিয়ার দণ্ড ও সাজা স্থগিত বা বাতিল এবং তাঁকে জামিন পেতে হবে।
হাইকোর্টে আপিল করা বিএনপির এই পাঁচ নেতা হলেন আমানউল্লাহ আমান, এ জেড এম জাহিদ হোসেন, ওয়াদুদ ভূঁইয়া, মো. মশিউর রহমান ও মো. আবদুল ওহাব। এই পাঁচ নেতার নির্বাচনে অংশ নেওয়াও এখন অনেকটাই অনিশ্চিত।
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা ও তাঁর অন্যতম আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, রাজনীতি ও নির্বাচন থেকে দূরে রাখার জন্যই খালেদা জিয়াকে মিথ্যা মামলায় দণ্ড দেওয়া হয়েছে। দণ্ড স্থগিত না হলে সংবিধান অনুযায়ী কোনো ব্যক্তি নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন না।
সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, খালেদা জিয়ার প্রার্থী হওয়া–না হওয়ার বিষয়টি আদালতের ওপর নির্ভরশীল। অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমসহ কয়েকজন আইনজ্ঞও বলছেন, দণ্ডিত হওয়ায় খালেদা জিয়া এবারের সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন না। সংবিধান অনুযায়ী, দুই বছরের বেশি কেউ দণ্ডিত হলে তিনি নির্বাচনে অংশ নেওয়ার যোগ্যতা হারান।
বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক খালেদা জিয়ার আইনজীবী কায়সার কামাল প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচন থেকে দূরে রাখতে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দায়ের করা এসব রাজনৈতিক মিথ্যা মামলায় কারাদণ্ড দেওয়া হচ্ছে। অবশ্য আওয়ামী লীগের আইনবিষয়ক সম্পাদক শ ম রেজাউল করিম প্রথম আলোকে বলেন, দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় আদালত খালেদা জিয়াকে কারাদণ্ড দিয়েছেন। এখানে কোনো রাজনীতি নেই।
নিম্ন আদালতের দণ্ড ও ভোটে অংশ নেওয়া নিয়ে বিতর্ক
সম্প্রতি আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, সংবিধান অনুযায়ী নৈতিক স্খলনের জন্য দুই বছরের বেশি সাজা হলে তিনি নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। তবে উচ্চ আদালতের দুটি রায় আছে। একটি রায় বলছে, আপিল করার পর সাজা স্থগিত হলে নির্বাচন করতে পারবেন। আরেকটি বিভক্ত রায়ে এক বিচারপতি বলেছেন, নির্বাচন করতে পারবেন; আরেকজন বলেছেন, পারবেন না।
তবে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মওদুদ আহমেদ বলছেন, খালেদা জিয়া নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন। কারণ, নিম্ন আদালতের দণ্ডই চূড়ান্ত দণ্ড নয়। নিম্ন আদালতের দেওয়া দণ্ডের বিরুদ্ধে খালেদা জিয়া হাইকোর্টে আপিল করবেন। আবার হাইকোর্টের দেওয়া দণ্ড বাতিল চেয়ে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আপিল করবেন খালেদা। মওদুদ আহমেদ মনে করেন, খালেদার আপিল চূড়ান্তভাবে নিষ্পত্তি না হওয়ায় আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন। বিচারিক আদালতে দণ্ডিত হওয়ার পরও আপিল করে সংসদ সদস্য পদ বহাল থাকার নজির আছে।
সংবিধান, বিভিন্ন রায় ও আইন কী বলে
সংবিধানের ৬৬ (২) গ অনুচ্ছেদ বলছে, কেউ নৈতিক স্খলনের অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়ে ন্যূনতম দুই বছর কারাবাসে থেকে মুক্তির পর পাঁচ বছর পার না হলে তিনি নির্বাচনে যোগ্য হবেন না।
১৯৯৩ সালে জনতা টাওয়ার দুর্নীতির মামলায় বিচারিক আদালতে দণ্ডিত হওয়ার সাত বছরের মাথায় সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মাদ এরশাদ সংসদ সদস্য পদ হারান। এর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে মামলা করলে ২০০১ সালের ২১ মে বিচারপতি জয়নাল আবেদীন ও বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ সংবিধানের ৬৬ (২) গ-তে উল্লেখিত কারাদণ্ডের ব্যাখ্যা দেন। বিচারপতি জয়নুল আবেদীন রায়ে বলেন, আপিল বিভাগের মাধ্যমে না বলা পর্যন্ত ‘দণ্ডিত হওয়া’ বোঝাবে । বিচারপতি খায়রুল হক রায়ে বলেন, বিচারিক আদালতে দোষী সাব্যস্ত হওয়ামাত্রই তিনি নির্বাচনে অযোগ্য হবেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিচারপ্রক্রিয়ায় যুক্ত ছিলেন এমন—একজন আইনজ্ঞ বলেন, দণ্ডিত হওয়ার পর আপিল করার মাধ্যমে একজন আসামি স্বীকার করে নেন, তিনি দণ্ডিত। সংবিধান অনুযায়ী, নৈতিক স্খলনের দায়ে দণ্ডিত হওয়ার পর আপিল করেই তিনি নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন না।
বিচারপতি মোস্তাফা কামাল এক রায়ে বলেছেন, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরে দুটি নির্দিষ্ট পরিস্থিতি ছাড়া আর কিছুতেই হাইকোর্টের হস্তক্ষেপ করা উচিত নয় ।
খালেদা জিয়ার নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তাঁর প্রার্থী হওয়ার বিষয়টি আদালতের ওপর নির্ভরশীল। সর্বোচ্চ আদালত বলেছেন, প্রার্থী হওয়ার বিষয়টি ইসির ওপর নির্ভরশীল। ইসির নেওয়া সিদ্ধান্তের বৈধতা রিটে পরীক্ষা না করতেও আপিল বিভাগের নির্দেশনা আছে। বৈধতা পরখ করতে চাইলে ভোটের পরে করতে হবে, ভোটের আগে নয়। তফসিলের পরে এগুলো নির্বাচনী বিরোধ হিসেবে বিবেচিত হবে। বিষয়টি দেখবেন নির্বাচনী ট্রাইব্যুনাল। হাইকোর্টের বিচারকদের নিয়ে গঠিত ট্রাইব্যুনাল অনধিক ছয় মাসের মধ্যে রায় ঘোষণা করবেন।
বিচারিক আদালতে দণ্ডিত হওয়ার পর আপিল করে সংসদ সদস্য পদ বহাল থাকার নজির আছে। দুর্নীতির মামলায় ২০০৮ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকার একটি আদালত ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরীকে ১৩ বছর কারাদণ্ড দেন। আর সম্পদের তথ্য গোপনের মামলায় ২০১৬ সালের ৩ নভেম্বর সরকারদলীয় সংসদ আবদুর রহমান বদির তিন বছর কারাদণ্ড দেন ঢাকার একটি আদালত।
দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলেন, দুর্নীতি দুটি মামলায় দণ্ডিত খালেদা জিয়া সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। কারণ, হাইকোর্ট বিচারিক আদালতের দণ্ড বাতিল করেননি, সাজা বাড়িয়েছেন। দণ্ড বাতিল বা স্থগিত না হলে প্রার্থী হওয়ার সুযোগ থাকে না।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার সাখাওয়াত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, দণ্ডিত হওয়ায় সংবিধান ও গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশ অনুযায়ী খালেদা জিয়া নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার যোগ্যতা হারিয়েছেন। (সূত্র : প্রথম আলো অনলাইন ভার্সন)