অভিনয়শিল্পী ও নির্মাতা আমজাদ হোসেন আর নেই (ইন্নালিল্লাহি… রাজিউন)। ব্যংককের বামরুনগ্রাদ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আজ শুক্রবার বাংলাদেশ সময় দুপুর ২টা ৫৭ মিনিটে তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। তার বয়স হয়েছিল ৭৬ বছর। মৃত্যুর খবরটি জনকণ্ঠকে নিশ্চিত করেছেন আমজাদ হোসেনের বড় ছেলে সাজ্জাদ হোসেন দোদুল। তিনি বলেন, আমার ভাই সোহেল আরমান সেখানে আছে। আমি ঢাকা থেকে সব সময় বাবার খোঁজ নিচ্ছিলাম। নিউরোসাইট বাদে শরীরের অন্যান্য সমস্যাগুলো উন্নতির দিকে যাচ্ছিল কিন্তু হঠাৎ করে এমন দু:সংবাদ শুনতে হবে ভাবতে পারছি না।
বর্ষীয়ান এ নির্মাতা ১৮ নবেম্বর সকালে ব্রেন স্ট্রোক করেন। এরপরই তাকে তেজগাঁওয়ের ইমপালস হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানেই আইসিইউতে ভর্তি ছিলেন তিনি। হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসক শহীদুল্লাহ সবুজের সার্বিক তত্ত্বাবধানে চিকিৎসা চলছিল তার। শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ার কারণে ১৯ নবেম্বর থেকে নিউরো মেডিসিন বিভাগের প্রধান, সার্জারি বিভাগের প্রধান, কার্ডিওলজি বিভাগের প্রধান, আইসিইউ বিভাগের প্রধানসহ ছয় সদস্যের মেডিকেল বোর্ড গঠন করে চিকিৎসা চলছিল।
এই নির্মাতার শারীরিক অসুস্থতার খবর শুনে হাসপাতালে ভর্তির তিন দিনের মাথায় তার চিকিৎসার সব দায়িত্ব নেওয়ার আশ্বাস দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য এয়ার এম্বুলেন্স বাবদ ২২ লক্ষ ৩৫ হাজার টাকা এবং চিকিৎসার জন্য প্রাথমিকভাবে ২০ লক্ষ টাকা প্রদান করেন।
আমজাদ হোসেনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ২৭ নবেম্বর দিবাগত রাত ১টার দিকে থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে নিয়ে যাওয়া হয়।
থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককের বামরুনগ্রাদ হাসপাতালে আমজাদ হোসেন নিউরো সার্জারি বিশেষজ্ঞ ডাক্তার টিরা ট্যাংভিরিয়াপাইবুনের তত্ত্বাবধানে ছিলেন। বুধবার দোদুল জনকণ্ঠকে জানিয়েছিলেন, বাবার প্রেসার খুবই লো। প্রেসার ওঠা-নামা করছে। কিডনির ক্রিয়েটিনিন লেভেল, যেটা অস্বভাবিকভাবে বেড়ে যাচ্ছিল, সেটা কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এসেছে। হার্টবিট ঠিক আছে। তার হার্টকে স্ট্যাবল রাখার চেষ্টা করা হচ্ছিল। আর ইনফেকশনগুলো বাড়তে দেওয়া হচ্ছে না। মোটামুটি কিডনি ও লান্স ইনফেকশন কন্ট্রোলে আছে। ডাক্তাররা হাত ও পায়ের এক্সটারনাল ইনফেকশন কন্ট্রোলে নিয়ে আসছে। তিনি বলেন, নিউরো সার্জারি ডাক্তার টিরা ও মেডিসিনের ভ্রংসা এক পর্যায়ে আমাদের বলেছিলেন, বাবার হাত কেটে ফেলতে হবে। কিন্তু তার পরেও বাবা বেঁচে থাকবেন কিনা এ নিশ্চয়তা তারা দিতে পারেন নি। আমরা বলেছিলাম তা হলে হাত কাটতে দিব না। কেননা যে হাত দিয়ে বাবা উপন্যাস লিখেছেন, বিখ্যাত বিখ্যাত ছবি তৈরি করেছেন, সেই হাত থাকবে না, এই অবস্থায় বাবা আমাদের মাঝে থাকবেন এটা মেনে নিদে পারছিলাম না। মেডিসিনের মাধ্যমে বাবার সেসব জায়গা এখন অনেক উন্নতির দিকে। এখন আর হাত কাটা লাগবে না। তবে নিউরো সাইট এখনও সেই অবস্থায় রয়েছে। সেটাকে মেডিসিন দিয়ে নিরাময় করার চেষ্টা চলছে। এই সাইট এখনও ইমপ্রুভ হয় নাই। বাবা এই হাসপাতালের ৫৩০ নম্বর রুমে আছেন।
কিংবদন্তি এই নির্মাতার মৃত্যুর খবরে শোকের ছায়া নেমে এসেছে সংস্কৃতি অঙ্গনে। নির্মাতা এস এ হক অলীক বলেন, অনেক বড় ক্ষতি হয়ে গেল আমাদের ইন্ডাস্ট্রির। উনার শূন্যতা কেউ পূরণ করতে পারবে না।
আমজাদ হোসেনের জন্ম ১৯৪২ সালের ১৪ আগস্ট, জামালপুরে। শৈশব থেকেই তার সাহিত্যচর্চা শুরু। পঞ্চাশের দশকে ঢাকায় এসে সাহিত্য ও নাট্যচর্চার সঙ্গে জড়িত হন। প্রথমেই তিনি অভিনয়ে নিজেকে তুলে ধরেন মহিউদ্দিন পরিচালিত ‘তোমার আমার’ চলচ্চিত্রে। এর পরপরই তিনি অভিনয় করেন মুস্তাফিজ পরিচালিত ‘হারানো দিন’ চলচ্চিত্রে। এরপরের ইতিহাস একেবারেই অন্যরকম। সালাহ উদ্দিন আমজাদ হোসেনের লেখা নাটক ‘ধারাপাত’ নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। এতে আমজাদ হোসেন নায়ক হিসেবে অভিনয়ও করেন। এরপর তিনি জহির রায়হানের ইউনিটে কাজ শুরু করেন। এভাবেই দীর্ঘদিন কাজ করতে করতে ১৯৬৭ সালে তিনি নিজেই চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। নাম ‘জুলেখা’। এরপর নূরুল হক বাচ্চুর সঙ্গে যৌথভাবে নির্মাণ করেন ‘দুই ভাই’। তার পরিচালিত ব্যাপক দর্শকপ্রিয় চলচ্চিত্রগুলো হচ্ছে ‘বাল্যবন্ধু’, ‘পিতাপুত্র’, ‘এই নিয়ে পৃথিবী’, ‘বাংলার মুখ’, ‘নয়নমণি’, ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’, ‘সুন্দরী’, ‘কসাই’, ‘জন্ম থেকে জ্বলছি’, ‘দুই পয়সার আলতা’, ‘সখিনার যুদ্ধ’, ‘ভাত দে’, ‘হীরামতি’, ‘প্রাণের মানুষ’, ‘সুন্দরী বধূ’, ‘কাল সকালে’, ‘গোলাপী এখন ঢাকায়’, ‘গোলাপী এখন বিলেতে’ ইত্যাদি। গুণী এই পরিচালক ১৯৭৮ সালে ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’ এবং ১৯৮৪ সালে ‘ভাত দে’ চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন। শিল্পকলায় অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান একুশে পদক (১৯৯৩) ও স্বাধীনতা পুরস্কারেও ভূষিত করে।