মালদ্বীপের পর এবার শ্রীলঙ্কাতেও চীনের মুখের গ্রাস কেড়ে নিল ভারত। দ্বীপরাষ্ট্রে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ফের শপথ নিয়েছেন রনিল বিক্রমাসিংহে। রাজনীতিতে ঘরের মাঠে গোল খেলেও, বিদেশের মাটিতে বেশ ভালো অবস্থানেই আছে ভারতের মোদি সরকার।পদত্যাগ করে পিছু হটেছেন চীনপন্থী বলে পরিচিত মাহিন্দা রাজাপক্ষে। আঞ্চলিক রাজনীতির হিসাবে আরেকবার জয়ী হলো ভারত!
শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রোববার শপথ নিয়েছেন রনিল বিক্রমাসিংহে। শপথ গ্রহণের পর প্রেসিডেন্ট মাইথ্রিপালা সিরিসেনার সঙ্গে দেখা গেছে হাস্যোজ্জ্বল রনিলকে। যে প্রেসিডেন্ট-প্রধানমন্ত্রীর বিরোধে পুরো দেশ অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতায় ভুগল এত দিন, এবার তাঁরাই একসঙ্গে কাজ করতে চলেছেন। বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, দুজনের মধ্যে আবার ঠোকাঠুকি লাগলে দ্বীপরাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। কিন্তু এত তিক্ততার পর সেই শঙ্কা কি উড়িয়ে দেওয়া সম্ভব?
সংকটের শুরু গত অক্টোবর মাসের ২৬ তারিখ। ওই দিন পার্লামেন্ট স্থগিত করে রাজাপক্ষকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেন সিরিসেনা। বরখাস্ত হন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহে। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত মানতে অস্বীকৃতি জানান রনিল। প্রধানমন্ত্রীর জন্য নির্ধারিত বাসভবনও ছাড়তে রাজি হননি তিনি। ওদিকে সংকট আরও ঘনীভূত করে রনিলের জন্য নিয়োজিত নিরাপত্তা ব্যবস্থা তুলে নেওয়ার আদেশ আসে প্রেসিডেন্টের তরফ থেকে। শুরু হয় সাংবিধানিক সংকট।
একপর্যায়ে কয়েক ভাগে বিভক্ত হয়ে যায় শ্রীলঙ্কা। রাজাপক্ষে ও সিরিসেনার পক্ষ নেয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। কিন্তু পার্লামেন্টের স্পিকার নেন রনিলের পক্ষ। স্পিকার বলেন, রনিলের পক্ষেই বেশির ভাগ পার্লামেন্ট সদস্য। গত ৯ নভেম্বর পার্লামেন্ট বিলুপ্ত ঘোষণা করেন সিরিসেনা। এর তিন দিনের মাথায় সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হোন রনিল পক্ষ। শুরুতেই আদালত পার্লামেন্ট বিলুপ্তির সিদ্ধান্ত স্থগিত করেন। এই ফাঁকে পার্লামেন্টে পাস হয় সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব। চলতি মাসের তিন তারিখ রাজাপক্ষে ও তাঁর মন্ত্রী পরিষদকে বরখাস্তের আদেশ দেন আদালত। এর দিন কয়েক পরে প্রেসিডেন্ট সিরিসেনার নেওয়া পার্লামেন্ট স্থগিতের সিদ্ধান্তকে ‘অসাংবিধানিক’ বলে আদালত রায় দেন। এমন সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়ায় গত শনিবার পদত্যাগ করেন রাজাপক্ষকে।
কিন্তু কি নিয়ে সিরিসেনা ও রনিলের মধ্যে এত মতবিরোধ? বার্তা সংস্থা রয়টার্স বলছে, সিরিসেনাকে হত্যার কথিত ‘ষড়যন্ত্রে’ পাত্তা দেননি রনিল। আর তাতেই খাপ্পা সিরিসেনা। অবশ্য তদন্তকারীরা বলছেন, সন্দেহজনক কিছু নাকি পাওয়া যায়নি! তবে সিলন টুডে’কে সম্প্রতি দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে প্রেসিডেন্ট সিরিসেনা বলেছেন, রনিল নাকি প্রচণ্ড উদাসীন ছিলেন এই তদন্তের বিষয়ে। আর সেটিই তাঁদের পারস্পরিক সম্পর্কে চূড়ান্ত ফাটল ধরায়।
রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড শ্রীলঙ্কায় নতুন কিছু নয়। গৃহযুদ্ধ আক্রান্ত দেশটিতে এমন হত্যাকাণ্ড অনেক ঘটেছে। সুতরাং সিরিসেনার উদ্বেগ অস্বাভাবিক নয়। রনিল অবশ্য দাবি করেছেন, তদন্তে একদমই নাক গলাননি তিনি। নিন্দুকদের অভিযোগ, হত্যার এই ষড়যন্ত্রে নাকি ভারত জড়িত ছিল।
তবে শুধু এই কারণেই কি পার্লামেন্ট বিলুপ্তির মতো ঘোষণা দিতে পারেন একজন প্রেসিডেন্ট? এই উপমহাদেশে ভারত ও চীনের ‘ছায়াযুদ্ধ’ আর নতুন কিছু নয়। মালদ্বীপে এর স্পষ্ট চেহারা দেখা গেছে। চীনপন্থী ঠেকানো গেছে আবদুল্লাহ ইয়ামিনকে। এবার ছিল শ্রীলঙ্কার পালা। রাজাপক্ষ হুট করে প্রধানমন্ত্রী হয়ে যাওয়ায় কপালে ভাঁজ পড়েছিল ভারতের। কারণ ভূরাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ শ্রীলঙ্কায় নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখা ভারতের জন্য অতীব প্রয়োজন। অন্যদিকে ভারতকে ঠেকাতে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ঢুকতে চায় চীন। তাই শ্রীলঙ্কা-মালদ্বীপের মতো দ্বীপরাষ্ট্রগুলোর বন্দরের নিয়ন্ত্রণ দরকার চীনের।
কলম্বোর বন্দরনায়েকে সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের পরিচালক হারিন্দা ভিদানাগে ভয়েস অব আমেরিকাকে বলেছেন, শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক সংকটের ছায়ায় আসলে লড়ছে ভারত-চীন। রাজাপক্ষের ক্ষমতায় থাকার অর্থই হচ্ছে, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের নিয়ন্ত্রণ চীনের হাতে চলে যাওয়া। অন্যদিকে রনিল বিক্রমাসিংহে চীনকে দূরে ঠেলে, কাছে আনছেন ভারত ও জাপানকে। সুতরাং রনিলের জয় এক অর্থে ভারতের বিজয়!
এই নতুন পরিস্থিতিতে মনে করা হচ্ছে, শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক অচলাবস্থা কাটল বলে। তবে অনেকে বলছেন, এরপরও বিপাক থেকে উদ্ধার পাবে না শ্রীলঙ্কা। পড়বে চীনের অর্থনৈতিক হুমকির মুখে। গ্লোবাল রিস্ক ইনসাইটসে প্রকাশিত এক নিবন্ধে বলা হয়েছে, চীনের কাছ থেকে ১৫০০ কোটি ডলারেরও বেশি ঋণ নিয়েছে শ্রীলঙ্কা। হামবানটোটা বন্দর আটকে গেছে ঋণের ফাঁদে। এর ১৫ হাজার একর জমি ৯৯ বছরের জন্য লিজ নিয়েছে এক চীনা কোম্পানি। বিশ্লেষকেরা বলছেন, সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি হলেও চীনের খপ্পর থেকে সহজে মুক্তি নেই দ্বীপরাষ্ট্রটির।