মাসুম গাজী, বিশেষ প্রতিনিধি :
পয়েন্টসম্যান বা পি-ম্যান নামক গুরুত্বপূর্ণ কর্মীর সঙ্কট কাটাতে পারছে না বাংলাদেশ রেলওয়ে। ফলে রেলওয়ের বেশ কয়েকটি স্টেশনই ঝুঁকিতে রয়েছে। কারণ ট্রেন চলাচল নির্বিঘ্ন করতে পয়েন্টসম্যান অতি জরুরি ভূমিকা পালন করে। পয়েন্টসম্যানই স্টেশন ছাড়ার আগে ট্রেনচালকের কাছে ট্র্যাক ও অন্যান্য বিষয়ে স্টেশনমাস্টারের নির্দেশনা পৌঁছে দেয়। আবার কোথাও কোথাও রেল ট্র্যাক পরিবর্তনের কাজটিও করে পয়েন্টসম্যান। কিন্তু রেলপথ মন্ত্রণালয় পয়েন্টসম্যান সংকট কাটাতে নিয়োগবিধি সংশোধনে কালক্ষেপণ করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বাংলাদেশ রেলওয়ে সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বাংলাদেশ রেলওয়ের পয়েন্টসম্যানের পদটি চতুর্থ শ্রেণীর। ওই পদে রেলওয়ের সরাসরি নিয়োগের সুযোগ নেই। বিদ্যমান নিয়োগবিধি অনুযায়ী রেলওয়ের ট্রাফিক বিভাগে গেটকিপার, পোর্টার, সিলম্যান ও ওয়েটিংরুম বেয়ারাসহ অন্যান্য চতুর্থ শ্রেণীর পদে ন্যূনতম ৩ বছর কর্মরতদের মধ্য থেকে পয়েন্টসম্যান নিয়োগ দিতে হয়। কিন্তু মামলাজনিত কারণে এক দশক ধরে ট্রাফিক বিভাগে চতুর্থ শ্রেণীর লোকবল নিয়োগে ধীরগতির পাশাপাশি একাধিক পদের নিয়োগ প্রক্রিয়া আটকে আছে। আর ওই কারণে পি-ম্যান পদেও পদোন্নতিযোগ্য কর্মী পাওয়া যাচ্ছে না। বর্তমানে রেলওয়ের উভয় অঞ্চলে মঞ্জুরিকৃত পয়েন্টসম্যান পদের সংখ্যা ১ হাজার ৪৪৫টি। তার মধ্যে শূন্য পদ রয়েছে ৪৭১টি। রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলে পয়েন্টসম্যানের সংকট সবচেয়ে তীব্র। ওই অঞ্চলে মঞ্জুরিকৃত ৭৫০টি পদের বিপরীতে কর্মরত রয়েছেন মাত্র ৪১৮ জন পয়েন্টসম্যান। সর্বশেষ ৩১ ডিসেম্বর অবসরোত্তর ছুটিতে গেছেন ৩৯ জন। তাছাড়া ২০১৯ সালে ২৭ জন এবং ২০২০ সালে আরো ২৬ জন পয়েন্টসম্যান অবসরে যাবেন। তাতে ২০২০ সালের মধ্যে পূর্বাঞ্চলে কর্মরত পয়েন্টসম্যানের সংখ্যা দাঁড়াবে ৩৬৫ জনে, যা মঞ্জুরিকৃত পদের প্রায় অর্ধেক। এমন অবস্থায় নিয়োগবিধি সংশোধনের মাধ্যমে ফিডার পদ থেকে পি-ম্যান নিয়োগ দেয়া না গেলে রেলওয়ে সংশ্লিষ্টরা ট্রেন পরিচালনা ঝুঁকির মধ্যে পড়বে বলে আশঙ্কা করছেন। কারণ প্রতিটি ট্রেন স্টেশন পার হওয়ার সময় স্টেশন মাস্টারের লিখিত একটি বার্তা পয়েন্টসম্যান ট্রেনের চালককে পৌঁছে দেন। কোনো স্টেশনে ট্রেন পবেশের অনুমতি পেতে জটিলতা তৈরি হলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কন্ট্রোল রুমের সঙ্গে যোগাযোগ করে স্টেশন মাস্টার সেখানে প্রবেশ করতে যাওয়া ট্রেনের জন্য একটি নির্দেশনামূলক বার্তা তৈরি করেন। এভাবে একজন পয়েন্টসম্যান উভয়মুখী ট্রেনের জন্য দৈনিক সর্বমোট ১৫টি বার্তা বা ওপিটি (অপারেশনাল ট্রান্সপোর্টেশন) বহন করে পৌঁছে দেন। অনেক সময় সংশ্লিষ্ট স্টেশনে থাকা ট্রেনেও চলন্ত অবস্থায় চালকের কাছে বার্তা পৌঁছাতে হয় বলে পি-ম্যানের কাজটি কষ্টসাধ্য ও ঝুঁকিপূর্ণ। এমন অবস্থায় নির্বিঘœ ট্রেন পরিচালনার জন্য পি-ম্যান ছাড়া কোনো স্টেশন চালু রাখা সম্ভব নয়। সূত্র জানায়, প্রায় ২ বছর আগে নিয়োগবিধি সংশোধন করে রেলের বিভিন্ন বিভাগ থেকে পয়েন্টসম্যান নিয়োগের উদ্যোগ নেয়া হয়। তবে রেলের পরিবহন বিভাগের ওই উদ্যোগ এখনো মন্ত্রণালয়ে আটকে আছে। এমন পরিস্থিতিতে পয়েন্টসম্যান পদে কর্মী সংকটের কারণে আগামী জুনের মধ্যে শুধুমাত্র পূর্বাঞ্চলেই রেলের ২০টি স্টেশন বন্ধ হয়ে যেতে পারে। একই কারণে নিরাপদ ট্রেন পরিচালনা বিঘিœত হওয়ার আশঙ্কাও তৈরি হয়েছে। নিয়োগবিধি সংশোধনের মাধ্যমে পি-ম্যান নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু করতে ২০১৭ সালের জুলাইয়ে একটি চিঠি পাঠান রেলওয়ের তৎকালীন মহাপরিচালক। রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিবকে দেয়া ওই চিঠিতে ফিডার পদ থেকে চাহিদা অনুযায়ী পয়েন্টসম্যান না পাওয়ায় রেলওয়ের নিয়োগবিধি-১৯৮৫ সংশোধনের অনুরোধ জানানো হয়। তার মাধ্যমে পয়েন্টসম্যানের ৬০ শতাংশ শূন্যপদে সরাসরি নিয়োগ এবং ৪০ শতাংশ পদ রেলের যেকোনো বিভাগের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মীদের পদোন্নতি দিয়ে পূরণের অনুরোধ জানানো হয়। সেক্ষেত্রে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে এসএসসি বা সমমান ও ফিডার পদ থেকে পদোন্নতির ক্ষেত্রে ৩ বছরের চাকরির যোগ্যতা রাখতে প্রস্তাব করা হয়। কিন্তু ওই চিঠি প্রাপ্তির পর এখনো কোনো উদ্যোগ নেয়নি রেলপথ মন্ত্রণালয়। সূত্র আরো জানায়, বাংলাদেশে যে পদ্ধতিতে ট্রেন চলাচল করে তাতে পয়েন্টসম্যান ছাড়া সেবাপ্রদান অসম্ভব। সর্বশেষ গত ২৯ ডিসেম্বর হাজীগঞ্জ স্টেশনে কাজ শেষে বাড়ি ফেরার পথে শামসুল হক নামে এক পি-ম্যান সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন। ওই স্টেশনে মঞ্জুরীকৃত ৩টি পি-ম্যান পদের বিপরীতে কর্মরত ছিলেন ২ জন। তার মধ্যে একজন মারা যাওয়ায় স্টেশনটির কার্যক্রম পরিচালনা দুরূহ হয়ে পড়েছে। তার আগে ২৭ ডিসেম্বর শশীদল স্টেশনের পি-ম্যান মুজিবুল হক স্টেশন থেকে বাড়ি ফেরার পথে মারা যান। ওই স্টেশনে মঞ্জুরিকৃত পি-ম্যান ২ জন। একজনের মৃত্যু হওয়ায় ঝুঁকিতে পড়েছে গুরুত্বপূর্ণ স্টেশনটিতে ট্রেন চলাচল। তাছাড়া চলতি বছরের ১ জানুয়ারি কুমিল্লায় ২ জন, ইমামবাড়ীতে একজন, কসবায় একজন, চাঁদপুরে একজন ও চট্টগ্রামে একজন পি-ম্যান অবসরে যান। ক্রমাগত অবসরে যেতে থাকায় পি-ম্যানের সংকট তীব্র হয়ে উঠেছে। এদিকে পি-ম্যান নিয়োগবিধি সংশোধনের এখতিয়ার রেলপথ মন্ত্রণালয়ের থাকলেও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন চাওয়ায় দীর্ঘসূত্রতা তৈরি হচ্ছে। ২০১৭ সালের জুলাইয়ে নিয়োগবিধি সংশোধনের প্রস্তাব পাওয়ার পর একই বছরের ১২ সেপ্টেম্বর রেলপথ সচিবের পক্ষ থেকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবকে ফিডার পদ থেকে পয়েন্টসম্যানে পদোন্নতি বিধি সংশোধনে ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করা হয়। অন্যদিকে রেলওয়ে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রেলের পি-ম্যান সংকট কাটাতে রিক্রুটমেন্ট রুলস সংশোধন জরুরি। এ ক্ষমতা রেলওয়ে সচিবের থাকলেও অজানা কারণে প্রস্তাব পাঠানোর পর দেড় বছর অতিক্রান্ত হলেও কোনো সিদ্ধান্ত দেয়া হচ্ছে না। ফলে যে কোনো সময় একাধিক গুরুত্বপূর্ণ স্টেশন বন্ধ করে দেয়া হতে পারে। তাতে রেল সেবায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা বাড়ছে। অন্যদিকে এ প্রসঙ্গে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মোফাজ্জেল হোসেন জানান, রেলের লোকবল সংকট দীর্ঘদিনের। পয়েন্টসম্যানেরও সংকট আছে। বিষয়টি মন্ত্রণালয়ের নজরে রয়েছে। রেলের মহাপরিচালক কিংবা দুই অঞ্চলের মহাব্যবস্থাপকরাও সংকটের বিষয়টি জানিয়েছেন। আশা করা যায় দ্রুত এ বিষয়ে একটি সমাধানে আসবে রেলপথ মন্ত্রণালয়।