বেতন বৈষম্যের প্রতিবাদে শ্রমিক বিক্ষোভ চলছেই। ন্যূনতম মজুরি পুনঃনির্ধারণের দাবিতে পোশাক শ্রমিকরা গতকাল পঞ্চমদিনের মতো বিক্ষোভ করেছেন। কোথাও কোথাও বিক্ষুব্ধদের রাস্তা থেকে সরাতে গিয়ে পুলিশ ও শ্রমিকদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে লাঠিচার্জ ও টিয়ারশেল নিক্ষেপ করেছে পুলিশ। সকল গ্রেডে সমহারে মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে গতকাল বিক্ষোভ হয়েছে রাজধানীর মিরপুরে। কালশী এলাকায় সকাল থেকেই বিক্ষোভ শুরু করেন পোশাক শ্রমিকরা। এতে স্ট্যান্ডার্ড গার্মেন্টসসহ আশপাশের কয়েকটি পোশাক কারখানার শ্রমিকরা খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে কর্মসূচিতে অংশ নেন।
এ সময় কালশীসহ আশপাশের সড়কে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। আশপাশের এলাকায় বিপুলসংখ্যক পুলিশ সদস্যসহ জলকামান, সাঁজোয়া যান মোতায়েন করা হয়।
এরমধ্যেই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেখানে শ্রমিকদের উপস্থিতি বাড়তে থাকে। একপর্যায়ে পুলিশ কর্মকর্তাদের সহায়তায় স্ট্যান্ডার্ড গ্রুপের মালিক মোশাররফ হোসেন ঘটনাস্থলে গিয়ে শ্রমিকদের সঙ্গে আলোচনা করেন। আলোচনার একপর্যায়ের শ্রমিকরা সড়ক থেকে সরে যায়। এদিন বিক্ষোভ হয়েছে- সাভার, গাজীপুর ও চট্টগ্রামে। সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে গতকাল মন্ত্রণালয়ে আয়োজিত বৈঠক কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই শেষ হয়েছে। বৈঠক শেষে জানানো হয়েছে, যেসব গ্রেডে মজুরি নিয়ে অভিযোগ উঠেছে তা পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। শ্রমিকদের কাজে যোগ দেয়ার আহ্বান জানিয়ে বলা হয়, আগামী রোববার বৈঠকে সার্বিক বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
সাভার থেকে জানান, সাভার-আশুলিয়ায় টানা পঞ্চমদিনের মতো গতকালও বিক্ষোভ করেছে তৈরি পোশাক শ্রমিকরা। দাবি আদায়ে শ্রমিকরা বাইপাইল-আব্দুল্লাহপুর সড়ক ও বিশমাইল-জিরারো সড়কে অগ্নিসংযোগসহ অবরোধ করে। সকালে আশুলিয়ার বেরন ও কাঠগড়া এলাকায় এ সড়ক অবরোধের ঘটনা ঘটে। বেরন এলাকার শারমিন গ্রুপের এএম ডিজাইন কারখানার শ্রমিকরা কাজ না করে সড়কে বেরিয়ে আসে। এ সময় তাদের সঙ্গে স্থানীয় ডিজাইনার জিন্স, উইন্ডি গ্রুপ, স্টারলিংক, হলিউড ফ্যাশনসহ বিভিন্ন কারখানার কয়েক হাজার শ্রমিক বিক্ষোভে অংশ নেয়।
একপর্যায়ে শ্রমিকরা আগুন জ্বালিয়ে সড়ক অবরোধের চেষ্টা করলে পুলিশ এতে বাধা দেয়। পরে শ্রমিকরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে টিয়ারসেল নিক্ষেপ করে। এ সময় শ্রমিক ও পুলিশের মধ্যে দফায় দফায় ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনায় শ্রমিক ও পুলিশসহ অন্তত ৩০ জন আহত হয়। একপর্যায়ে বিজিবি ও পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অতিরিক্ত সদস্যদের উপস্থিতিতে যানচলাচল স্বাভাবিক হয়। একই দাবিতে আশুলিয়ার কাঠগড়া এলাকায় অবস্থান নিয়েও অগ্নিসংযোগ করে ৩ঘণ্টা সড়ক অবরোধ করে রাখে পোশাক শ্রমিকরা। খবর পেয়ে সকাল ১১টার দিকে আশুলিয়া থানার ওসি শেখ রিজাউল হক দিপুর নেতৃত্বে পুলিশ সদস্যরা ঘটনাস্থলে পৌঁছে শ্রমিকদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। শাহাদাত হোসেন নামে এক শ্রমিক বলেন, কারও ইন্ধনে নয়, ন্যায্য দাবি আদায়ের জন্যই আমরা আন্দোলন করছি। মকবুল নামে অপর শ্রমিক বলেন, সরকার যদি গেজেট করে বেতন বৃদ্ধি করে তাহলে একেক কারখানায় বেতন একেক রকম কেন।
যেসব কারখানা কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের সঠিকভাবে বেতন দিচ্ছে সে কারখানাতে তো কোনো আন্দোলন হচ্ছে না। সেখানে শ্রমিকরা শান্তিপূর্ণভাবেই কাজ করছে। আশুলিয়া শিল্প পুলিশ-১ এর পরিচালক সানা শামিনুর রহমান বলেন, শ্রমিক বিক্ষোভের ঘটনায় আশুলিয়ার কাঠগড়া ও জামগড়া এলাকায় শ্রমিকরা রাস্তা অবরোধের চেষ্টা করলে তাদের ধাওয়া দিয়ে সরিয়ে দেয়া হয়। শ্রমিক বিক্ষোভের ঘটনায় বৃহস্পতিবার প্রায় ৩০টি কারখানায় সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। এ ছাড়া যেকোনো ধরনের অপ্রীতিকর পরিস্থিতি মোকাবিলায় শিল্পাঞ্চলের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অতিরিক্ত পুলিশ ও বিজিবি মোতায়েন রয়েছে।
গাজীপুর থেকে জানান, গাজীপুরে গতকাল তীব্র বিক্ষোভ করেছে পোশাক শ্রমিকরা। এ সময় পুলিশ ও শ্রমিকদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও সংঘর্ষ হয়েছে। ইটপাটকেলের আঘাতে ও পুলিশের লাঠিচার্জে বিভিন্নস্থানে অন্তত ২০ জন আহত হয়েছেন। পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে নগরের ভোগড়া, মোগরখাল, বড়বাড়িসহ আশপাশের এলাকায় অন্তত ২০টি কারখানা ছুটি ঘোষণা করা হয়।
বিকালে নগরের ইটাহাট এলাকার মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করে শ্রমিকরা। ভাঙচুর করা হয় কয়েকটি যানবাহন। শ্রমিকদের বিক্ষোভে দ্রুত আশপাশের বিভিন্ন গার্মেন্টের শ্রমিকরা অংশ নেন। এ সময় ইটাহাটা এলাকার কোস্ট টু কোস্ট কারখানার শ্রমিকরা ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে নেমে বিক্ষোভ করেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে শুরুতে লাঠিচার্জ করে পুলিশ। এ সময় এক নারী শ্রমিক আহত হলে শ্রমিকরা উত্তেজিত হয়ে ওঠে। এ সময় লাঠিসোঁটা হাতে নিয়ে নারী শ্রমিকরা মহাসড়কে নেমে অবরোধ করে, তারা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। একপর্যায়ে শ্রমিকদের সঙ্গে পুলিশের ব্যাপক ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও সংঘর্ষ হয়েছে।
বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা জানায়, নগরের মোগরখাল এলাকায় বিসিএল কারখানার শ্রমিকরা তাদের দাবি আদায়ের লক্ষ্যে সকালে কাজ করতে না চাইলে কর্তৃপক্ষ অপারেটর আল আমিনসহ কয়েকজন নারী শ্রমিককে মারধর ও গালাগাল করে। এতে শ্রমিকরা উত্তেজিত হয়ে কারখানা থেকে বের হয়ে বিক্ষোভ করে। পরে মোগরখাল, ভোগড়াসহ আশপাশ এলাকার কারখানার শ্রমিকরাও কাজ বন্ধ করে বিক্ষোভে অংশ নেয়। এই অবস্থায় আশপাশের এলাকার কমপক্ষে ১৫টি কারখানা ছুটি ঘোষণা দেয়া হয়। অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে এসব শিল্প এলাকাগুলোতে বিপুল সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
এদিকে ফুঁসে উঠেছেন বন্দরনগরী চট্টগ্রামের পোশাক শ্রমিকরাও। শ্রমিক নেতারা বলছেন, ঢাকার পরিস্থিতিতে চট্টগ্রামেও পোশাক শ্রমিকদের মাঝে অসন্তোষ দানা বাঁধছে। কিন্তু চট্টগ্রামের গার্মেন্টস মালিক ও প্রশাসনের সহমর্মিতাসুলভ মনোভাবের কারণে শ্রমিকরা এখনো মাঠে নামেনি। তবে, এ পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত হলে শ্রমিকদের বেশিদিন ধরে রাখা অসম্ভব হয়ে পড়বে। তাই শ্রমিকদের দাবি দাওয়া মেনে নেয়ার জোর দাবি জানান তারা।
চট্টগ্রাম ইপিজেড পোশাক শ্রমিক নেত্রী মরিয়ম খাতুন বলেন, ঢাকার পরিস্থিতি নিয়ে গার্মেন্টস মালিকরা চট্টগ্রামের শ্রমিক সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। মালিকরা বলছেন, ঢাকার পরিস্থিতিতে শ্রমিকদের বিষয়ে যে সিদ্ধান্তই আসুক না কেন সেটা তারা মেনে চলবেন।
মজুরি কাঠামোর মূল সমস্যা চিহ্নিত, রোববার ফের বৈঠক
পোশাক শ্রমিকদের বেতন বৈষম্য নিরসনে পর্যালোচনা কমিটির প্রথম বৈঠকেই মজুরি কাঠামোর মূল সমস্যা চিহ্নিত করা হয়েছে। মজুরি কাঠামোর সাতটি গ্রেডের মধ্যে ৩, ৪ ও ৫ নম্বর গ্রেডে অসঙ্গতি তৈরি হয়েছে। মালিক-শ্রমিক ও সরকার ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে এ সমস্যা শনাক্ত করা হয়। গতকাল পোশাক শ্রমিকদের নতুন মজুরি কাঠামো পর্যালোচনার জন্য গঠিত ১২ সদস্যের কমিটির প্রথম সভা শ্রম মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব ও কমিটির আহ্বায়ক আফরোজা খান।
বৈঠক শেষে তিনি বলেন, যেহেতু সমস্যা শনাক্ত হয়েছে সেহেতু সমস্যা সমাধান করা যাবে। আগামী রোববার (১৩ই জানুয়ারি) কমিটির বৈঠক আবার বসবে। ওই বৈঠকে চিহ্নিত তিনটি গ্রেডের বিষয় সমাধানের চেষ্টা করা হবে।
সভা শেষে শ্রম সচিব বলেন, আমরা দেখতে পেয়েছি সাতটি গ্রেডের মধ্যে ১ ও ২ সম্পর্কে উনাদের মন্তব্য হচ্ছে সেখানে কোনো সমস্যা নেই। ৬ ও ৭ নম্বর গ্রেডেও কোনো সমস্যা নেই। শুধু ৩, ৪ ও ৫ নম্বর গ্রেডে একটু অবজারভেশন আছে, সেটা আমলে নিয়েছি। তিনি বলেন, এখানে যেহেতু ক্যালকুলেশনের ব্যাপার আছে, সেজন্য আরো গভীরভাবে পর্যালোচনার জন্য আরো ছোট পরিসরে আগামী রোববার বসে সেটার সমাধান খুঁজে বের করব। কোথায় কীভাবে করলে সেই সমন্বয়টা আমরা করতে পারি। যাতে এই সমস্যা সমাধান হয়।
তিনি বলেন, কমিটিকে বিষয়টি সমাধানে এক মাসের সময় দেয়া হয়েছিল। ওই সময়ের আগেই বিষয়টির সমাধান হয়ে যাবে। সরকার যে শ্রমিকবান্ধব তা উল্লেখ করে তিনি বলেন, শ্রমিকদের কারও বেতনই কমবে না। মজুরি কাঠামোর কারণে যে অস্থিতিশীলতা তৈরি হচ্ছে তা নয়, এর পেছনে অন্য ঘটনা রয়েছে যার একটি উদাহরণ উল্লেখ করে আফরোজা খান বলেন, মজুরি কাঠামোর চাইতে বেশি বেতন দেয়া হয় এমন একটি কারখানা ভাঙচুর করা হয়েছে। তিনি বলেন, অর্থনীতির মূলভিত্তি হচ্ছে গার্মেন্টস খাত। এ খাতকে ধ্বংস করার জন্য একটি চক্র পেছন থেকে কলকাঠি নাড়ছে। এ কারণে সবাইকে সজাগ থাকার আহ্বান জানান তিনি।
শ্রমিকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, শুধু বেতনই নয়, শ্রমিকরা যেকোনো সমস্যায় পড়লে একটি হটলাইন নম্বর চালু করবে শ্রম অধিদপ্তর। রাত-দিন ২৪ ঘণ্টা সেই নম্বরে ফোন দিয়ে শ্রমিকরা তাদের সমস্যা জানাতে পারবেন। সমস্যার যাতে তাৎক্ষণিক সমাধান হয় তার ব্যবস্থাও থাকবে। নম্বরটি শিল্প অঞ্চলে মাইকিং করে জানানো হবে।’
বৈঠকে ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন, বাংলাদেশ তৈরিপোশাক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান, বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র প্রার্থী আতিকুল ইসলাম এবং বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি ও সংসদ সদস্য আব্দুস সালাম মুর্শিদীসহ গার্মেন্টস মালিক, শ্রমিক এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের পর্যালোচনা কমিটির ১২ সদস্যের মধ্যে ১০ জন উপস্থিত ছিলেন।
গার্মেন্ট শ্রমিকদের ওপর পুলিশি দমন-পীড়ন বন্ধের আহ্বান জার্মান রাষ্ট্রদূতের
আন্দোলনরত গার্মেন্ট শ্রমিকদের ওপর পুলিশি দমনপীড়ন বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন বাংলাদেশে নিযুক্ত জার্মানির রাষ্ট্রদূত পিটার ফারেনহোলজ। শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি দেয়ার জন্য তিনি কারখানা মালিকদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। এক টুইটে তিনি গতকাল এসব কথা বলেছেন বলে খবর দিয়েছে ডেইলি স্টার।
টুইটে তিনি লিখেছেন, আন্দোলনরত গার্মেন্ট শ্রমিকদের ওপর পুলিশের দমনপীড়ন চালানো উচিত নয়। এর জন্য প্রয়োজন সমঝোতা। তা করতে হবে কারখানা মালিকদের। ন্যায্য মজুরি ও নিরাপদ কর্মপরিবেশ দিন। দুর্ঘটনা বা অ্যাক্সিডেন্ট বিষয়ক ইন্স্যুরেন্স প্রতিষ্ঠা করুন। সরকারের আড়ালে থাকবেন না। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের দ্বিতীয় সর্ববৃহৎ ক্রেতা দেশ জার্মানি। এক্ষেত্রে প্রথম অবস্থানে আছে যুক্তরাষ্ট্র।