খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা বিএনপি’র সভাপতি খান আলী মুনসুর (৬৩) হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে ইন্তেকাল করেছেন (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। গতকাল বুধবার ১৬ জানুয়ারী সকাল সাড়ে ৮টার দিকে খুলনার হাসপাতালে নেয়ার পথে মৃত্যু হয় তার। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী, একপুত্র ও এক কন্যাসহ অসংখ্য আত্মীয়-স্বজন ও গুণগ্রাহী রেখে যান।
এদিকে তাঁর মৃত্যুর খবর পেয়ে উপজেলার ভান্ডারপাড়া গ্রামস্থ নিজ বাড়িতে পড়ে শোকাহত মানুষের ঢল। এ সময় দলীয় নেতা-কর্মী ছাড়াও দলমত নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষ তাকে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন এবং কান্নায় ভেঙে পড়েন। বিকেলে উপজেলা স্বাধীনতা স্মৃৃতিসৌধ চত্বরে মরহুমের নামাজের জানাজ শেষে সন্ধ্যায় পারিবারিক কবর স্থানে তাঁর দাফন সম্পন্ন হয়। হিন্দু-মুসলিম, দল-মত নির্বিশেষে সকলের প্রিয় মুনসুর ভাই নামেই পরিচিত ছিলেন তিনি।
পরিবার সূত্রে জানা গেছে, তিনি দু’সপ্তাহ আগে থেকে বুকে ব্যাথা ও শ্বাসকষ্ট অনুভব করছিলেন। হঠাৎ গতকাল সকাল ৮টার দিকে গোসল সেরে খাওয়ার টেবিলে বসেন। এরইমধ্যে তিনি চেয়ার থেকে ঢলে মেঝেতে পড়ে অচেতন হয়ে যান। তাৎক্ষণিকভাবে স্বজনরা তাকে এ্যাম্বুলেন্স যোগে খুলনায় রওনা দেন। পথিমধ্যে তাঁর মৃত্যু হয়।
গতকাল বুধবার বিকেলে উপজেলার মহান স্বাধীনতা স্মৃতিসৌধ পরিষদ চত্বরে তাঁর নামাজের জানাজা ও নিজ দল বিএনপিসহ বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে ফুলেল শ্রদ্ধা জানানো হয়। এরই মধ্যে তাঁর জানাজায় হাজার হাজার ছিল মানুষের ঢল নামে। এ সময় তাঁর কর্মজীবন তুলে ধরে বক্তৃতা করেন জেলা বিএনপি’র সভাপতি এড. শফিকুল আলম মনা, নগর সাধারণ সম্পাদক সাবেক সিটি মেয়র মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান মনি, জেলা বিএনপি নেতা সাবেক সাংসদ ডাঃ গাজী আব্দুল হক, মোল্লা আবুল কাশেম, জেলা বিএনপি সাধারণ সম্পাদক আমির এজাজ খান, মোল্লা মোশাররফ হোসেন মফিজ, শেখ মতিয়ার রহমান বাচ্চু, জি এম আমাউল্লাহ, গাজী আব্দুল হালিম, আ’লীগ নেতা শাহনেওয়াজ হোসেন জোয়ার্দার, ইউপি চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল খোকন, গুটুদিয়া ইউপি চেয়ারম্যান মোস্তফা সরোয়ার, জাপা নেতা গাজী গওহর, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ফরহাদ হোসেন মোড়ল, ডুমুরিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোছাঃ শাহনাজ বেগমের পক্ষে তার স্বামী খুবি’র প্রফেসর ড. আহসান হাবিব, উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভুমি) মোঃ নাজমুল হাসান, মরহুমের পুত্র জিয়াউর রহমান জীবন ও তার নিকট আতœীয় শেখ শাহিনুজ্জামান। বক্তৃতা শেষে নামাজের জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। নামাজে ইমামতি করেন মাওলানা মাহাবুর রহমান। পরে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন শেষে তাঁর মরদেহ ভান্ডারপাড়া গ্রামে নিয়ে যাওয়া হয় এবং পারিবারিক কবর স্থানে দাফন সম্পন্ন হয়।
অশ্র“সজল চোখে জননন্দিত নেতা ডুমুরিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান ও স্থানীয় বিএনপি’র সভাপতি খান আলী মুনসুরকে শেষ বিদায় জানিয়েছেন হাজারো জনতা। শীতের কুয়াশাচ্ছন্ন বিকেল যেন শোকাহত সহস্র জনতার বেদনা ও হৃদয়ের আর্তিকে ধারণ করেই ¤্রয়িমান হয়ে পড়েছিল বেলা গড়াবার বেশ আগেই। উপজেলা পরিষদের স্বাধীনতা চত্বরের সুবিশাল মাঠ জণাকীর্ণ হয়ে পড়ে আসরের নামাজের সাথে সাথে। স্থানীয় মসজিদগুলোতে সব মুসল্লীর ঠাঁই হয়নি। এই মাঠে অনুষ্ঠিত হয়েছে নামাজের জামাত।
এমনই এক মুহূর্তে বিদায়ের করুণ সাইরেন বাজিয়ে জনগনের প্রিয় নেতা খান মুনসুরের নিথর দেহবাহী এ্যাম্বুলেন্স পৌছায় জানাজাস্থলে। এ সময় শেষ বারের মতো এক নজর তাকে দেখার জন্য মানুষের ভেতর যেমন আকুলতা ছিল, ঠিক তেমনই অনেককে দেখা যায় তাদের অশ্র“সজল চোখ মুছতে। জানাজায় কাতারে যতো না মানুষ দাঁড়িয়েছিলেন, কাতারের বাইরে দাঁড়ানো মানুষের সংখ্যাও একেবারে কম ছিল না। সাদা ধুতি অথবা শাখা-শিঁদুর পরা এসব মানুষগুলোও ছিলেন বেদনায় শোকে মুহ্যমান। হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে ডুমুরিয়াবাসীর প্রিয় স্বজন, আপন ভাইসম খান মুনসুরের বিদায়লগ্নে তারা সবাই ছিলেন একসাথে।
জানাজার আগে খান মুনসুরের দীর্ঘ দিনের রাজনৈতিক সহযোদ্ধা মোল্লা আবুল কাশেম এবং মরহুমের পুত্র সবুজ বক্তব্য রাখতে দাঁড়ালে গোটা মাঠে কান্নার রোল পড়ে যায়। দলীয় পতাকায় আচ্ছাদিত করা হয় মরহুমের কফিন। তবে ধর্মীয় বিধিনিষেধের কথা উল্লেখ্য করে ফুলেল শ্রদ্ধা জানানো থেকে দলীয় নেতা-কর্মীদের বিরত রাখা হয়। এদিকে মরহুম খান আলী মুনসুরের জানাজায় জেলা ও মহানগর বিএনপি, ডুমুরিয়া-ফুলতলা-দাকোপ-বটিয়াঘাটা-কয়রা-পাইকগাছা-রূপসা-তেরখাদা-দিঘলিয়া থেকে বিএনপি, ছাত্রদল, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল, কৃষক দল, শ্রমিক দল নেতৃবৃন্দ অংশ নেন। জাফরউল্লাহ খান সাচ্চু, শাহজালাল বাবলু, অধ্যক্ষ তারিকুল ইসলাম, আরিফুজ্জামান অপু, আসাদুজ্জামান মুরাদ, মহিবুজ্জামান কচি, শফিকুল আলম তুহিন, এহতেশামুল হক শাওন, সাজ্জাদ আহসান পরাগ, শামসুজ্জামান চঞ্চল, জোয়াদ্দার রসুল জলি, সরদার রবিউল ইসলাম প্রমুখ। খান আলী মুনসুরের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ, মরহুমের রুহের মাগফিরাত কামনা এবং শোক সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন জেলা ও নগর বিএনপির নেতৃবৃন্দ।
জেলা বিএনপি : বিবৃতিদাতারা হলেন জেলা বিএনপি’র সভাপতি এড. শফিকুল আলম মনা, সিনিয়র সহ-সভাপতি ডাঃ গাজী আব্দুল হক, সাধারণ সম্পাদক আমীর এজাজ খান, গাজী তফসির আহমেদ, খান জুলফিকার আলী জুলু, এড. এম এ আজিজ, শেখ আব্দুর রশিদ, এস এম মনিরুল হাসান বাপ্পী, মোস্তফা উল বারী লাভলু, জি এম কামরুজ্জামান টুকু, আশরাফুল আলম নান্নু, শামসুল আলম পিন্টু, আলী আসগর, এড. একেএম শহিদুল আলম, মুর্শিদুর রহমান লিটন, ওয়াহিদুজ্জামান রানা প্রমুখ।
নগর বিএনপি : অনুরূপ বিবৃতিদাতারা হলেন বিএনপি’র চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা এম নুরুল ইসলাম, কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও নগর সভাপতি নজরুল ইসলাম মঞ্জু, সাধারণ সম্পাদক সাবেক মেয়র মনিরুজ্জামান মনি, সাহারুজ্জামান মোর্ত্তজা, কাজী সেকেন্দার আলী ডালিম, সৈয়দা নার্গিস আলী, মীর কায়সেদ আলী, শেখ মোশারফ হোসেন, জাফরউল্লাহ খান সাচ্চু, জলিল খান কালাম, সিরাজুল ইসলাম, ফখরুল আলম, এড. ফজলে হালিম লিটন, অধ্যক্ষ তারিকুল ইসলাম, শেখ আমজাদ হোসেন, অধ্যাপক আরিফুজ্জামান অপু, সিরাজুল হক নান্নু, ইকবাল হোসেন খোকন ও আসাদুজ্জামান মুরাদ প্রমুখ।
ফোয়াব : ডুমুরিয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আলী মনসুরের মৃত্যুতে গভীর শোক ও শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করে বিবৃতি দিয়েছেন ফিস ফার্ম ওনার্স এসোসিয়েশন বাংলাদেশ ফোয়াব’র নেতৃবৃন্দ। বিবৃতিদাতারা হলেন সভাপতি মোল্যা সামছুর রহমান শাহীন, গৌরপদ বাছাড়, এম এ মান্নান বাবলু, লস্কর মনিরুজ্জামান, সাধারণ সম্পাদক মোঃ ওয়াজেদ আলম, শেখ সাকিল হোসেন, কানাই মন্ডল, নাসির আহমেদ, মোঃ অহিদুজ্জামান, গোবিন্দ রায়, মাওলানা মোঃ শহীদুল ইসলাম, ড. বায়জীদ মোড়ল, মোস্তফা কামাল মানিক, শেখ মোঃ সরোয়ার হোসেন, মোঃ বাহাদুর শেখ, সাফায়েত হোসেন শাওন, মোঃ ওমর ফারুক, লস্কর উবাইদুর রহমান, কৃষিবিদ মুরর্শিদা পারভীন পাপড়ি ও তপক মন্ডল তপু প্রমূখ।
অনরূপ শোক প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছেন খুলনা টিভি ক্যামেরা জার্নালিস্ট এ্যাসোসিয়েশনের নেতৃবৃন্দ। বিবৃতিদাতারা হলেন সভাপতি আবু সাঈদ, সহ-সভাপতি শাহজালাল মোল্লা মিলন, সাধারণ সম্পাদক হাসান আল মামুন, যুগ্ম-সম্পাদক আমির সোহেল, কোষাধ্যক্ষ আরিফ বিল্লাহ নির্বাহী সদস্য নিয়ামুল হোসেন কচি, মেহেদী হাসান পলাশ, রকিবুল ইসলাম মতি, আজিজুল ইসলাম, খায়রুল আলম, জাকারিয়া হোসেন তুষার, শেখ জুয়েল, আরাফাত হোসেন অনিক, আমিনুর রহমান নিউটন, আবুল বাশার, মনিরুল ইসলাম সাগর, সোহেল, শেখ রাসেল, সুদীপ, রফিক আলী
সংক্ষিপ্ত জীবনী : মরহুম খান আলী মুনসুর ১৯৫৫ সালে উপজেলার ভান্ডারপাড়া গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। তিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সকলের ছোট। ডুমুরিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করে এইচএসসি ও বিএ পাস করেন মধুগ্রাম কলেজ থেকে। এরই মধ্যে তিনি রাজনীতি ও সংসার জীবনে প্রবেশ করেন। তিনি পারভীন বেগম ও জিয়াউর রহমান জীবন নামের দুই সন্তানের জনক।
খান আলী মুনসুর ১৯৭৩ সালে ডুমুরিয়া এনজিসি এন্ড এনসিকে মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাশ এবং মধুগ্রাম কলেজ থেকে ডিগ্রী পাশ করেন। ছাত্র জীবন থেকে তিনি রাজনীতিতে হাতেখড়ি দেন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) থেকে। বিএনপি প্রতিষ্ঠার পর তিনি ১৯৭৯ সালের ১২ ডিসেম্বর তিনি জাসদ থেকে শহিদ জিয়ার দলে যোগ দেন। ১৯৮১ সালে ডুমুরিয়া থানার সাবেক গ্রাম সরকার প্রধান ছিলেন। ১৯৮৪ সালে উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি নির্বাচিত হন। পরে তিনি উপজেলা যুবদলের সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৬ সালে উপজেলা বিএনপি’র সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ওইপদে তিনি দুই বার দায়িত্বপালন করেন। এরপর দুইবার উপজেলা বিএনপি’র সভাপতি পদে নির্বাচিত হন তিনি। এছাড়া জেলা বিএনপি’র সাবেক সহ-সভাপতি হিসেবেও দায়িত্বে ছিলেন তিনি। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ২০০১ সালে ভান্ডারপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন এবং ২০০৩ ও ২০১১ সালেও তিনি ওই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে সুনামের সাথে তিন তিন বার দায়িত্বপালন করেন। ২০১৪ সালে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে তিনি বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়ে উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। (তথ্য সংগ্রহ : সময়ের খবর )