কাসেম সোলাইমানির স্থলভিষিক্ত হয়েছেন নতুন জেনারেল ইসমাইল গণি

121

ইরানের আলোচিত বাহিনী কুদস ফোর্সের প্রধান জেনারেল কাসেম সোলাইমানি মার্কিন ড্রোন হামলায় নিহত হওয়ার পর তার স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন নতুন জেনারেল। তার নাম ইসমাইল গণি। কুদস ফোর্স মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে ইরানের অসংখ্য প্রক্সি বাহিনী পরিচালনা করে থাকে। ইরানের বিপ্লবী রক্ষী বাহিনীর অংশ কুদস ফোর্স মূলত একটি প্যারামিলিটারি সংগঠন। এই সংগঠনের প্রধান সরাসরি জবাবদিহি করেন কেবলমাত্র ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনির কাছে। কুদস ফোর্সই ইরানের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রকল্প দেখভালের দায়িত্বে আছে। এছাড়া পারস্য উপসাগরে অবস্থানরত মার্কিন নৌবাহিনীকে ঘেরাও দিয়ে রাখার মতো নৌ বাহিনীও আছে কুদস ফোর্সের। এ খবর দিয়েছে বার্তা সংস্থা এপি।

খবরে বলা হয়, পূর্বসুরি সোলাইমানির মতো তরুণ বয়সে ইসমাইল গণিও ইরাক-ইরান যুদ্ধ সরাসরি প্রত্যক্ষ করেছেন।

আশির দশকে হওয়া ৮ বছর ব্যাপী ওই যুদ্ধে ভয়াবহ নৃশংতা দেখেছেন তিনি। এরপরই মূলত তিনি কুদস ফোর্সে যোগ দেন।
৬২ বছর বয়সী গণির বিষয়ে তেমন তথ্য জানা নেই। তবে তার ওপর দীর্ঘদিন ধরে ঝুলছে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা। এ থেকে ইঙ্গিত মেলে যে, তিনি এই সংগঠনের উঁচু স্তরে কাজ করছেন অনেকদিন থেকে।

সোলাইমানি ও গণি দীর্ঘদিনের বন্ধু। সোলাইমানি সম্পর্কে একবার এক সাক্ষাৎকারে গণি বলেন, ‘আমরা দু’জনেই যুদ্ধের শিশু। আমরা যুদ্ধক্ষেত্রের সহযোদ্ধা। লড়াই করতে গিয়েই আমরা একে অপরের বন্ধু হয়েছি।’
সাম্প্রতিক দশকগুলোতে ইরানে রাজনৈতিক ও সামরিকভাবে বিপ্লবী রক্ষীবাহিনী ক্রমশই ক্ষমতাধর হয়েছে। এই প্রভাব ও ক্ষমতার অন্যতম কারণ কুদস ফোর্স। মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে মৈত্রী ও সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে তুলেছে কুদস। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও দেশটির আঞ্চলিক মিত্র রাষ্ট্রগুলোর কাছে রয়েছে অত্যাধুনিক সব সমরাস্ত্র। এর বিপরীতে অনিয়মিত বা গেরিলা কায়দায় হুমকি সৃষ্টি করেছে ইরানের এই প্রক্সি বাহিনীগুলো। এসব প্রক্সি সংগঠনের মধ্যে রয়েছে ইরাকের মিলিশিয়া দল, লেবাননের হিজবুল্লাহ, ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহী গোষ্ঠী, ইত্যাদি।

ইসমাইল গণিকে সোলাইমানির স্থলাভিষিক্ত করে ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি বলেছেন, ইরানের সামরিক বাহিনীর সবচেয়ে প্রখ্যাত অধিনায়কদের একজন তিনি। খামেনি বলেন, জেনারেল গণির নেতৃত্বে কুদস ফোর্স অপরিবর্তিত থাকবে।
দীর্ঘদিন ধরে সোলাইমানিই ছিলেন কুদস ফোর্সের প্রতীক। ইরাকে মার্কিন সৈন্যদের টার্গেট করে হওয়া বোমা হামলার জন্য সোলাইমানিকে দায়ী করেছিলেন মার্কিন জেনারেলরা। এরপর থেকেই খ্যাতি তুঙ্গে ওঠে তার। ইরাক, সিরিয়া, লেবানন ও ইয়েমেনে সোলাইমানির বিভিন্ন কীর্তি নিয়ে হাজারো বিশ্লেষণ বের হলেও, গণি যেন অনেকটা তার ছায়ার আড়ালে ছিলেন। পশ্চিমা সংবাদ মাধ্যমে তো বটেই, ইরানি সংবাদ মাধ্যমেও তিনি কথা বলতেন খুব কম। তবে ব্যক্তি হিসেবে সোলাইমানির জীবনের সঙ্গে তার সাদৃশ্য অনেক বেশি।

১৯৫৭ সালের ৮ আগস্ট উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় ইরানি শহর মাশদাদে জন্ম জেনারেল গণির। রাজ শাসনের শেষ দশকে তিনি বড় হয়ে ওঠেন। ১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের এক বছর পর তিনি রক্ষী বাহিনীতে যোগ দেন। সোলাইমানির মতো তিনি প্রথমবারে লড়াইয়ের ময়দানে নামেন কুর্দি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে। শাহ রাজশাসনের অবসানের পর ওই বিদ্রোহ দেখা দিয়েছিল। এরপর ইরাক আক্রমণ করলো ইরানে। শুরু হয় ৮ বছর মেয়াদী যুদ্ধের। এই সংঘাতে মারা যায় প্রায় ১০ লাখ মানুষ। এদের অনেকেই রক্ষী বাহিনীর স্বল্প অস্ত্রসস্ত্রে সজ্জিত সদস্য। এদের কেউ কেউ ছিলো অল্পবয়সী। যারা সারিবদ্ধ হয়ে ছুটে যেতো ইরাকি অবস্থান লক্ষ্য করে। গণি ওই সময়কার কথা মনে করে বলেন, ‘স্বেচ্ছাসেবী এসব কিশোর ও তরুণরা দেখতো যে, যারাই যাচ্ছে সবাই মরে যাচ্ছে। কিন্তু আমরা যখন তাদেরকে বলতাম, যাও! তারা একদমই দ্বিধা করতো না। অধিনায়ক তার সৈন্যদের নিজের সন্তানের মতো দেখতেন। আর সৈন্য মনে করতো তাকে অবশ্যই নির্দেশ পালন করতে হবে।’ ওই যুদ্ধের পর প্রতিষ্ঠিত হয় কুদস ফোর্স। যুদ্ধ শেষে গণি সেখানে যোগ দেন। তিনি সোলেইমানির সঙ্গে কাজ করেন। পাশাপাশি রক্ষী বাহিনীর প্রতি-গোয়েন্দা কর্মকান্ডের নেতৃত্ব দেন। পশ্চিমা বিশ্লেষকরা মনে করেন, সোলাইমানি ইরানের পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত দেশগুলো দেখতেন। গণি দেখতেন আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের মতো পূর্বের দেশগুলো। তবে রক্ষী বাহিনীতে তার রেকর্ড নিয়ে ইরানি রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত সংবাদ মাধ্যমে তেমন কিছু বলা হয়নি।

২০১২ সালে মার্কিন রাজস্ব বিভাগ গণির বিরুদ্ধে অবরোধ আরোপ করে। এ সময় সেখানে উল্লেখ করা হয়, কুদস ফোর্সের প্রক্সি বাহিনীর কাছে অর্থ বিতরণ করার কর্তৃত্ব বা ক্ষমতা গণির ছিলো। ২০১০ সালে নাইজেরিয়ার সবচেয়ে জনবহুল শহর লাগোসের একটি বন্দরে উদ্ধারকৃত অস্ত্রের চালানের নেপথ্যে গণি ছিলেন বলে অভিযোগ করা হয়।
ওই জাহাজ গাম্বিয়া যাওয়ার কথা ছিল। সেখানে গ্লাস, উল, পাথর থাকার কথা থাকলেও, উদ্ধার করা হয় কাতউশা রকেট, রাইফেল সহ অন্যান্য অস্ত্রসস্ত্র। প্রসঙ্গত, কাতউশা ইরানি প্রক্সি বাহিনীগুলোর প্রিয় সমরাস্ত্রের একটি। ইসরাইলি কর্মকর্তারা দাবি করেন, ওই অস্ত্র গাজার হামাসের কাছে যাওয়ার কথা। তবে নাইজেরিয়ান কর্মকর্তারা দাবি করেন, স্থানীয় রাজনীতিকরা সামনের নির্বাচনে ওই অস্ত্র ব্যবহার করতো।

২০১২ সালে গণি মন্তব্য করেন, সিরিয়ায় যদি ইরান না থাকতো, তাহলে আরও ভয়াবহ মাত্রায় হত্যাযজ্ঞ হতো। তখন মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে ওই মন্তব্যের কড়া সমালোচনা করা হয়। ২০১৫ সালে গণি পরোক্ষভাবে মন্তব্য করেন যে, ইসরাইলিদের বিরুদ্ধে লড়তে ফিলিস্তিনিদের ক্ষেপণাস্ত্র ও অস্ত্রসস্ত্র দিয়েছে ইরান।
ইরানি রক্ষী বাহিনীর ওপর একটি বই লিখেছেন আফশন অস্তোভার। তিনি বলেন, ‘ গণি রক্ষী বাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হিসেবে ও সোলাইমানির উপ-প্রধান হিসেবে বহুদিন কাজ করেছেন। এ থেকেই বোঝা যায় সোলাইমানি ও খামেনি তার ওপর কতটা আস্থা রাখেন। আমি মনে করি, কোনো অপারেশন ও কৌশল নির্ধারণের ক্ষেত্রে সোলাইমানির শূন্যতা পূরণে তার তেমন কষ্টই হবে না।’