লাখ লাখ মানুষের জীবন নিয়ে শংকা, যশোর – খুলনার ৬ টি নদী দখল

380

উৎপল ঘোষ ,ক্রাইম রিপোর্টার

সুজলা – সুফলা শস্য শ্যামলা আমাদের এই বাংলাদেশ। প্রাচীনকাল থেকে বিভিন্ন পরিব্রাজক ও পর্যটক যশোহর জেলায় আগমন তারই লক্ষ্য বহন করে। সপ্তম শতাব্দীতে প্রখ্যাত চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ যশোহর জেলা নামক এই ভূখণ্ডের মধ্যে এসে উচ্চসিত হয়ে  উচ্চারণ করেছিলেন প্রাকৃতিক লীলাভূমির দেশ আমাদের এই বাংলাদেশ। এর অপরুপ সৌন্দর্য সবাইকে মুগ্ধ করে। দেশের প্রায় সব অঞ্চলে জালের মতো ছড়িয়ে আছে নদী।প্রবাহিত ৫৭ টি নদীর মধ্যে ৫৪ টি নদীর জন্ম ভারত থেকে। নদী মাতৃক বাংলাদেশে নদী রক্ষার কথা শুনতে কেমন যেন বেমানান। দেশের সিংহভাগ নদী যখন বিপন্ন তালিকা ভূক্ত তখন কী আর উপায় থাকতে পারে? শেষ পযর্ন্ত উচ্চ আদালত এমনই নির্দেশনাই দিয়েছেন (৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯) হাইকোর্টের একটি দৈতবেঞ্চ নদী  রক্ষায় যুগান্তকারী রায় ঘোষনা করেছেন। রায়ে নদী ভূমি দস্যুদের নির্বাচনে ও ব্যাংকে ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে। দেশের সকল নদ – নদী খালের আইনগত অভিভাবক ঘোষণা এবং সব নদী খাল জলাশয় ও সমুদ্র সৈকতের সুরক্ষা কমিশন বাধ্য থাকবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

নদী দখলকে অপরাধ হিসাবে চিহ্নিত করে কঠিন সাজা ও জরিমানা নির্ধারণ করে অভিযোগ দায়ের করে, তদন্তের ব্যবস্থা রেখে ২০১৩ সালের নদী রক্ষা আইন সংশোধন করে ৬ মাসের মধ্যে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল এবং নদী রক্ষা কমিশনকে স্বাধীন ও কার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে সব ধরনের পদক্ষেপ নিতে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। রায়ে নির্দেশনায় স্পষ্ঠ উল্লেখ আছে দেশে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দই মাসে একদিন এক ঘন্টা করে নদী দূষনের ওপর সচেতন মূলক পাঠদানের ব্যবস্থাএবং বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে বলা হয়েছে। পাশাপাশি দেশের  বড়, মাঝারি,শিল্প কারখানার শ্রমিকদের অংশগ্রহণে দুই মাসে একদিন এক ঘন্টা করে নদী বিষয়ক বৈঠকের নির্দেশ দিয়ে বিষয়টি তদারকির জন্য শিল্প মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।এছাড়া ইউনিয়ন,উপজেলা  জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে তিন মাস পর একদিন ব্যাপী নদী বিষয়ক সেমিনারের আয়োজন এবং স্ব স্ব অধিক্ষেত্রে নদী দখলদারদের নাম প্রকাশ করতে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।

খুলনার ছাঁয়াপথ, দৈনিক আলোর জগত,দৈনিক নওয়াপাড়া, প্রথম আলো, দৈনিক আজকের বসুন্ধরা, দৈনিক প্রবাহ, দৈনিক কালের কন্ঠসহ বেশ কিছু পত্রিকা  শিরোনামে দেয়া হয়েছে ” হত্যার শিকার নদী ” যশোহর জেলায় ৬টি নদী খরস্রোতা ভৈরব, অপারভদ্রা, হরিহর, বুড়ি ভদ্রা, মুক্তেশ্বরী ও কপোতাক্ষ নদী আজ দখল –  দূষনের কবলে তাদের অস্তিত্ব হারাতে বসেছে। নদীগুলোর করুন দৃশ্য তুলে ধরা হয়েছে দীর্ঘদিন, ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করলে যা রীতিমতো লোমহর্ষক। খুলনা জেলার নদী দখল করে ২৭ টি ইটভাটা,রাজবাড়ি “পদ্মাসহ ৫ টি নদী এখন ধু ধু বালুচর ” ধলেশ্বরী নদীর জীবন নিয়ে শঙ্কা। একই সঙ্গে একথাও বলার প্রয়োজন যে,বিলুপ্ত নদ – নদীসহ প্রাকৃতিক জলাভূমিগুলো উদ্ধার এবং সাবেক অবস্থায় না ফেরাতে পারলে ভবিষ্যতে দেশ মহাসংকটের মুখোমুখি হবে।দীনবন্ধুর মিত্রর ‘নীল দর্পন ‘নাটকে সেখানে একটি প্রবাদে ছিল, “কাঙ্গালের কথা বাসী হলে ফলে”। আমাদের হয়েছে সেই দৈন্য দশা। দুই দশক আগে আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যে তাগিদ দেয়া হয়েছিল, আমরা তা অনুভব করিনি। আমাকে ঐ সময় অনেকেই বলতেন,দেশের নদ – নদী ও পরিবেশ দূষন নিয়ে আপনি পত্রিকায় রিপোর্ট করেন কেন উত্তরে বলতাম নদী ও পরিবেশ দূষন যদি রক্ষা করা না যায়,তাহলে এ দেশ হবে মরুভূমি। বিষাক্ত ইট ভাটার কালো ধোঁয়ায় ও কয়লার বিষাক্ত নিঃসৃত ধোঁয়ায় মানুষের জনজীবন হবে অতিষ্ঠ। দিন দিন মানব দেহে রোগ ব্যধির জন্ম হবে। নানা শ্বাসকষ্ঠ জনিত রোগে মানব কূল ভূগবে। সরকারি হাসপাতালে জায়গা হবে না রুগীর। ধুকে ধুকে মানুষ মরবে।  এরপর ২০১০ সালে উচ্চ আদালতের দেয়া আর একটি ঐতিহাসিক রায়ে ক্যাডের্স রিয়াল সার্ভে (সিএস) ম্যাপ অনুযায়ী যশোহর জেলার ছয়টি নদী ঢাকার চার নদী শীতলক্ষা, তুরাগ,বালু ও চট্টগ্রামের কর্ণফুলি সহ দেশের সকল নদী অবৈধ দখল মুক্ত সাবেক অবস্থায় ফিরিয়ে আনার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। রায়ের পর সরকার নড়েচড়ে বসল। গঠন করা হলো ” নদী বিষয়ক জাতীয় টাস্কফোর্স  ” শুরু হলো জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের কার্যক্রম। টাস্কফোর্সের সিদ্ধান্তে কয়েক দফা অভিযান চালিয়ে  যশোহর, ঢাকা ও চট্টগ্রামের কিছু অংশ অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হলো। যশোহর জেলার সদর আংশিক অংশ গুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। মুল গডফাদার ভূমি খেকোগং রয়েছে ধরা ছোঁয়ার বাইরে। কিন্তুু অভিযান শেষে ভূমিদস্যুরা নদীর বুকে হায়েনার মত আবার হানা দেন।

চলতি বছরে সরকার নদী খননের নামে যশোহর জেলার কেশবপুর, মনিরামপুর উপজেলায় অপার ভদ্রা,হরিহর নদী,বুড়ি ভদ্রা নদী ও পাশ্ববর্তী খালগুলো জলাবদ্ধ দূরীকরণ প্রকল্পের জন্য ৯ কোটি ৭ লক্ষ ৫০ হাজার আটাশি দশক আট এক টাকা কোটি বরাদ্দ দিয়েছেন। কাজটি পান ঢাকার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স খন্দকার শাহীন আহমেদ এন্ড তাজয়ার সিষ্টেমস লিঃ (জেভি)। বাস্তবায়নে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড। কাজটি চলতি বছরের ২৮ জুন ২০২০ ইং সালে শেষ করার কথা সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে ৩২৭ দিন। সে মোতাবেক ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান কাজ চালিয়ে যাচ্ছে বলে জানান, যশোহর জেলার পানি উন্নয়ন বোর্ড। বরাদ্দ দেওয়ার পরও কাঙ্ক্ষিত আশা পূরণ হচ্ছে না। কারণ সৎ কর্মকর্তা ও সঠিক তদারকি এবং ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের সৎ মন মানষিকতা থাকলে আশানুরুপ ফল পাওয়া সম্ভব। হাজার হাজার টন ময়লা আবর্জনা প্রতিদিন ভৈরব নদ সহ অন্যান্য নদে নিক্ষেপ করা হচ্ছে যা দেখার কেউ নেই। সবুজ শ্যামল বন বনানী আর সোনালী ফসল মাছ আর গাছের বিচিত্র সমারহ নিয়ে নদীগুলো বয়ে চলেছে।এসব নদী গুলো নদীর সাথে সংযুক্ত। কচুরিপানা আর পলিমাটি নদীর পরম শত্রু।নদীগুলোর বুক জুড়ে পলিমাটির আস্তরণ।বুকের উপর জলের সীমায় কচুরিপানায় চাদর দিয়ে জুড়ে রাখার প্রাকৃতিক কৌশল।কচুরিপানা তোলার জন্য কোন সামাজিক আন্দোলনের উদ্যোগ নেই। যশোহর শহরের কাছে ভৈরব অনেক আগেই অভিমানে আত্মহত্যা করেছে। এ কারণে যশোহরে শিল্প সমৃদ্ধি নেই। দক্ষিঞ্চলে সবচেয়ে পুরাতন জেলা হওয়া সত্বেও যশোহর যশ রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে। বিভাগীয় নামটিও জুটাতে অক্ষম হয়েছে। শিল্প শহর নওয়াপাড়ার প্লাস পয়েন্ট। যেটা যশোহরের মাইনাস। এর মূলে যার অবদান হলো তা ভৈরব। কিন্তুু ভৈরব দখল – দূষণে পক্ষাঘাতগ্রস্ত। কপোতাক্ষ নদের জায়গা দখল করে হাজার হাজার মৎস্য ঘের সহ একাধিক শিল্প প্রতিষ্ঠান ও ইমারত নির্মাণ করে চলেছে। যশোহর জেলার শিল্প শহর নওয়াপাড়ার ভাঙ্গাগেট মশরহাটী এলাকার ভৈরব সেতু সংলগ্ন এলাকা থেকে শুরু করে শিল্পঞ্চল রাজঘাট পযর্ন্ত অসংখ্যা পাড়ের জায়গা দখল করা হয়েছে। যা রিতীমত লোমহর্ষক। এ ছাড়া কয়লা ও রাসায়নিক সার ড্যম্পিং করে রাখা হয়েছে একাধিক স্থানে। যা পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। নদী শাসনের চেষ্টা চলছে। নদী রক্ষার জন্য সরকারের পাশাপাশি সকল মহলকে এগিয়ে আসতে হবে। দূষণকারী ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে বিবেকের বাতায়ন খুলে দেখতে হবে। সুতরাং এ সবের মধ্যে দিয়ে নদী রক্ষায় ভবিষ্যতে সমাজ ও রাষ্ট্রে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন আসবে বলে বিজ্ঞ মহল ধারণা করছেন।