শীর্ষ মানবাধিকার সংগঠণ ‘অধিকার” এর বিশ্ব মানবাধিকার দিবস পালিত

89

পুলিশের নির্যাতনে দু’ চোখ হারানো খুলনা মহানগরীর গোয়ালখালি রেললাইন এলাকার যুবক মো. শাহজালাল বলেন, ২০১৭ সালের ১৮ জুলাই পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে টাকা দাবি করে। কিন্তু টাকা দিতে না পারায় খালিশপুর থানার তৎকালীন ওসি নাসিম খানের নির্দেশে পুলিশ তার দু’ চোখ তুলে দেয়। তিনি তার চোখ ফিরিয়ে দেয়া এবং দোষিদের শাস্তি দাবি করেন।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস উপলক্ষে ১০ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার বেলা ১১টায় নগরীর শান্তিধাম মোড় সংলগ্ন জাতিসংঘ পার্কের সামনে দেশের শীর্ষ মানবাধিকার সংগঠণ ‘অধিকার’ খুলনা ইউনিটের উদ্যোগে আয়োজিত মানববন্ধন ও র‌্যালীতে অংশ নিয়ে চোখ হারানোর যন্ত্রণাদায়ক সেই ঘটনার বর্ননা দেন শাহজালাল। দু’ চোখ হারিয়ে এখন তিনি একমাত্র শিশু কন্যা ও স্ত্রীকে নিয়ে কিভাবে সংসার চালাবেন সে প্রশ্নও ছুড়ে দেন সরকারের কাছে।
একইভাবে এ কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে বেনাপোলের মেধাবী কলেজ ছাত্র মো. রেজোয়ান হোসেনের বড় ভাই মো. রিপন হোসেন বলেন, ২০১৬ সালের ৪ আগষ্ট পুলিশ তার ভাইকে ধরে নেয়ার পর থেকেই সে গুম রয়েছে। তাকে আর পাওয়া যায়নি। তিনিও তার ভাইকে ফেরত দিতে সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলার শিকার সিনিয়র সাংবাদিক দৈনিক মানবজমিনের খুলনা ব্যুরো প্রধান ও বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন-বিএফইউজের সহ-সভাপতি মো. রাশিদুল ইসলাম বলেন, সর্বশেষ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে খুলনা-১ আসনে রিটার্নিং অফিসার কর্তৃক ঘোষিত ফলাফল সংক্রান্ত তথ্য প্রকাশ করেন তিনি। ওই ফলাফলে ভুল থাকলেও সেটি স্বীকার না করে উল্টো তিনিসহ দু’জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দায়ের করা হয়। যা চরমভাবে সংবাদপত্রের স্বাধীনতাহরণ এবং মানবাধিকারের লঙ্ঘণ। তিনি অবিলম্বে তার বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলা প্রত্যাহার এবং এ কালো আইন বাতিলের দাবি জানান।
বাংলাদেশের কমিউনিষ্ট পার্টি খুলনা মহানগর শাখার সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও পাটকল শ্রমিক আন্দোলনের নেতা মিজানুর রহমান বাবু বলেন, সরকার কর্তৃক দেশের রাষ্ট্রায়ত্ব সব পাটকল বন্ধের প্রতিবাদে শ্রমিকদের পক্ষে আন্দোলন করতে গিয়ে তাকে কারাবরণ করতে হয়েছে। ১১টি ধারা দিয়ে ২৫০জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। তিনি বলেন, সংবিধান এবং ধর্মীয় দৃস্টিকোন থেকেও শ্রমিকের গাঁয়ের ঘাম শুকানোর আগেই তার মজুরি পরিশোধ করতে বলা হয়েছে। সেখানে শ্রমিকরা আন্দোলন করতে গিয়ে উল্টো হামলা-মামলার শিকার হচ্ছেন। তিনি দেশের গণতন্ত্র, বিচার ব্যবস্থা, নির্বাচন ব্যবস্থা এবং সমাজ ব্যবস্থাকে সাজিয়ে গুছিয়ে নতুন সমাজ বিনির্মানের লড়াইয়ে সকলকে শরীক হওয়ার আহবান জানান।
এ কর্মসূচিতে সভাপতিত্ব করেন সংগঠণের খুলনার ফোকাল পার্সন সাংবাদিক মুহাম্মদ নূরুজ্জামান। প্রধান অতিথি ছিলেন সিনিয়র সাংবাদিক ও নাগরিক ঐক্যের খুলনা মহানগর আহবায়ক অ্যাডভোকেট ড. মো. জাকির হোসেন। অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন সিনিয়র সাংবাদিক কাজী মোতাহার রহমান বাবু, গ্লোবাল খুলনার আহবায়ক শাহ মামুনুর রহমান তুহিন, নিরাপদ সড়ক চাই-নিসচা’র খুলনা জেলা সভাপতি এসএম ইকবাল হোসেন বিপ্লব, খুলনা পোল্ট্রি ও ফিস ফিড শিল্প মালিক গ্রুপের মহাসচিব এস এম সোহরাব হোসেন, মানবাধিকার সংগঠক শেখ আব্দুল হালিম, পরিবেশ সংগঠক মাহবুব আলম বাদশা, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলার শিকার সিনিয়র সাংবাদিক দৈনিক মানবজমিনের খুলনা ব্যুরো প্রধান মো. রাশিদুল ইসলাম, বাংলাদেশের কমিউনিষ্ট পার্টি খুলনা মহানগর শাখার সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও পাটকল শ্রমিক আন্দোলনের নেতা মিজানুর রহমান বাবু, পুলিশ কর্তৃক দু’টি চোখ উপড়ে ফেলা খুলনার যুবক মো. শাহ্জালাল, তার স্ত্রী রাহিলা বেগম এবং বেনাপোলে গুম হওয়া কলেজছাত্র রেজওয়ান হোসেনের বড় ভাই রিপন হোসেন।
উপস্থিত ছিলেন মানবাধিকার কর্মী মো. মাসুদুর রহমান, এম এ আজিম, শরীফ আহমেদ মোল্লা, আব্দুল কাইয়ূম খান, এসকে জামান, ওবায়দুল শেখ, মোহাম্মদ ইলিয়াস হোসেন, শহিদুল ইসলাম মাস্টার, সাকিব হাসান, ইমাম হোসেন মারুফ, মোঃ কামরুজ্জামান, টুটুল হোসেন, আসাদুল হোসেন, মোঃ আল-আমিন, চন্দন মন্ডল, মোহাম্মদ হোসেন, মো. শামীম হোসেন, মোঃ আব্দুর রহিম, মোহাম্মদ রফিক, শিমুল গোলদার, মো. পলাশ হোসেন, গালিব হাসান, তামিম হাসান প্রমুখ। ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন অধিকারের হিউম্যান রাইটস ডিফেন্ডার সাংবাদিক কে এম জিয়াউস সাদাত। এর আগে নগরীর ফুল মার্কেট সংলগ্ন প্রেস ক্লাব, খুলনা থেকে একটি র‌্যালী বের হয়ে জাতিসংঘ পার্কের সামনে গিয়ে শেষ হয়।
বক্তারা আরও বলেন, দেশে গুম, খুন অব্যাহত রয়েছে। বাক স্বাধীনতা নেই। কথা বলার অধিকার নেই। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নেই। বিরোধীমত ও সভা-সমাবেশের সুযোগ নেই। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে। সরকারের একদলীয় শাসন, কর্তৃত্ব, নির্যাতন-নিপীড়ন এবং রাষ্ট্রীয় বাহিনী কর্তৃক দমন-পীড়ন চলছে। অধিকার বঞ্চিত কেউ ন্যায্য অধিকার ফিরে পেতে রাজপথে নামলেই আইন-শৃংখলা বাহিনী কর্তৃক হামলা-মামলা-গ্রেফতার ও হয়রানির শিকার হচ্ছেন। সর্বত্রই লঙ্ঘিত হচ্ছে মানবাধিকার, হরণ করা হচ্ছে মানবতা। চরমভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘণের ঘটনায় গণতন্ত্র মুখ থুবড়ে পড়েছে। গণতন্ত্রের স্বাভাবিক গতি রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে নাগরিকদের স্বাধীনতা খর্ব হওয়ার সাথে সাথে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বও আজ হুমকির মুখোমুখি। বক্তারা সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সকলকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলার পাশাপাশি মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে একটি মানবিক রাস্ট্র গড়ে তুলতে সরকারকে এগিয়ে আসার আহবান জানান।
প্রসঙ্গত, মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’ ১৯৯৪ সালের ১০ অক্টোবর প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে মানবাধিকার রক্ষার লক্ষ্যে কাজে নিয়োজিত রয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় অধিকার বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-, নির্যাতন, গুম, রাজনৈতিক সহিংসতা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নাগরিকদের ওপর হামলা, বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত এলাকায় বাংলাদেশী নাগরিকদের উপর ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)’র নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ এবং নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা বন্ধের জন্য কাজ করছে।