গণতন্ত্র নয়। মিয়ানমার দখলে নিয়েছে সেনাবাহিনী। ‘নির্বাচনে জালিয়াতির’ অভিযোগে অভ্যুত্থান ঘটিয়েছে সেনারা। শান্তিতে পুরস্কারবিজয়ী অং সান সুচির নেতৃত্বাধীন গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করেছে তারা। সোমবার ভোরে সুচি, প্রেসিডেন্ট উইন মিন্টসহ ক্ষমতাসীন ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসির (এনএলডি) অনেক গুরুত্বপূর্ণ নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে সেনারা। এরপর সেনা মালিকানাধীন টেলিভিশনে সামরিক অভ্যুত্থানের ঘোষণা দেয়া হয়েছে। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত রাজধানীতে টহল দিচ্ছিল সেনাবাহিনী। এক বছরের জন্য জারি করা হয়েছে জরুরি অবস্থা।
ক্ষমতায় এসেছেন সেনাপ্রধান মিন অং হ্লাইং। তবে অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন সুচি। বেশ কয়েক বছর ধরে পশ্চিমারা এই দেশটিতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এই অভ্যুত্থান তাদের সেই প্রচেষ্টাকে পথচ্যুত করবে বলেই মনে করা হচ্ছে। নিকট প্রতিবেশী চীনের রয়েছে মিয়ানমারে শক্তিশালী প্রভাব। অভ্যুত্থানের পরে চীন যে প্রতিক্রিয়া দিয়েছে তা যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। তারা ইঙ্গিত দিয়েছে, মিয়ানমারের ভেতরকার সমস্যা তারাই সমাধান করবে। এর কূটনৈতিক অর্থ হতে পারে, এই সমস্যা সমাধানে বাইরের কারো প্রয়োজন নেই।
৮ই নভেম্বর পার্লামেন্ট নির্বাচন হয় মিয়ানমারে। সেই নির্বাচনে শতকরা ৮৩ ভাগেরও বেশি আসনে জয় পায় এনএলডি। এই নির্বাচনকে মিয়ানমারে গণতান্ত্রিক শাসনের পক্ষে গণভোট হিসেবে দেখা হচ্ছিল। নবনির্বাচিত পার্লামেন্টের প্রথম অধিবেশন বসার কথা ছিল সোমবার। কিন্তু তার মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে, সূর্য্যের আলো ফোটার আগেই অভ্যুত্থান ঘটিয়ে দিয়েছে সেনারা। তারা রাজধানী নেপিড, প্রধান বাণিজ্যিক শহর ইয়াঙ্গুনে ফোন ও ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। এনএলডি নেতাদের গ্রেপ্তারের পর সম্প্রচার বন্ধ হয়ে যায় রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখলের নিন্দায় সরব হয়েছে বিশ্ব। জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র থেকে শুরু করে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা এ অভ্যুত্থানের নিন্দা জানিয়েছে। আল জাজিরার এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, গভীর উদ্বেগের সঙ্গে ভারত পরিস্থিতির দিকে খেয়াল রাখছে। মিয়ানমারে গণতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতার হস্তান্তর প্রক্রিয়ার প্রতি ভারতের সমর্থন সব সময়ই অবিচল ছিল। আমরা বিশ্বাস করি যে, আইনের শাসন এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সমুন্নত থাকবে। আমরা নিবিড়ভাবে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি।
ওদিকে ইয়াঙ্গুন সহ বিভিন্ন এলাকায় বাজারঘাটগুলোতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনে মজুত রাখার জন্য মানুষের ভিড় পড়ে গেছে। এটিএম বুথগুলোতে অর্থ তোলার দীর্ঘ লাইন দেখা গেছে। ইন্টারনেট সংযোগ অত্যন্ত দুর্বল থাকার জন্য সারাদিন ব্যাংকগুলো তাদের সেবা স্থগিত করেছিল। এ সময় রাস্তায় টহল দিতে দেখা গেছে সেনাবাহিনীকে। এ অবস্থায় সুচির পক্ষ থেকে ফেসবুকে একটি পোস্ট দিয়েছে তার দল এনএলডি। এতে অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন সুচি। কিন্তু ভিন্ন দৃশ্য দেখা গেছে। সেনাবাহিনীকে সমর্থনকারীদেরও দেখা গেছে রাজপথে। তারা অভ্যুত্থানকে সেলিব্রেট জানাচ্ছিল জাতীয় পতাকা হাতে। পিকআপের ওপর অবস্থান নিয়ে তারা পতাকা নাড়াচ্ছিলেন। জাতীয়তাবাদী একজন বৌদ্ধ ভিক্ষু ফেসবুকে একটি ভিডিও পোস্ট করেছেন। তাতে তিনি সোমবারকে জনগণের জন্য খুশির দিন হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। কিন্তু গণতন্ত্রপন্থিরা এবং এনএলডিপন্থি ভোটারদের মধ্যে দেখা দিয়েছে ভীতি, ক্ষোভ। শিক্ষার্থী সি থুন তুন বলেছেন, আমার দেশ একটি পাখির মতো ছিল। সবেমাত্র সে উড়তে শিখছিল। কিন্তু সেনাবাহিনী আমাদের ডানা ভেঙে দিয়েছে। একজন নারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, আমরা এনএলডি সরকারকে ভোট দিয়েছিলাম। যদি তারা (সেনাবাহিনী) নির্বাচনের ফল নিয়ে অসন্তুষ্ট হতেন, হালে তারা আরেকটি নির্বাচন আহ্বান করতে পারতেন। কিন্তু তা না করে তারা অভ্যুত্থান ঘটিয়েছেন। এটা গ্রহণযোগ্য নয়। এমন মন্তব্যকারী নারীর স্বামীও একজন সেনা কর্মকর্তা।
ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছেন এনএলডি’র সিনিয়র নেতা উইন হতেই। এতে তিনি বলেছেন, সেনাপ্রধানের কাছে দেশ নিয়ে কোনো উদ্বেগ নেই। এর চেয়ে তার কাছে তার উচ্চাকাঙ্ক্ষাই বড়। তাই তিনি ক্ষমতা দখল করেছেন। উদ্ভূত পরিস্থিতির উল্লেখ করে পদত্যাগ করেছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মিন্ট হতই। তিনি সহকর্মীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন জনগণের সেবাদান অব্যাহত রাখতে, বিশেষ করে করোনাভাইরাস সংক্রমণের মধ্যে। সাই লিন মাইয়াত বলেছেন, সোমবার পার্লামেন্ট অধিবেশন শুরুর আগে এমপিদেরকে তাদের আবাসিক ভবনে অবরুদ্ধ করে রাখে সেনাবাহিনী।
মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের নিন্দা জানিয়েছে জাতিসংঘ। সব বন্দির মুক্তি দাবি করা হয়েছে। গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠারও আহ্বান জানানো হয়েছে। একই রকম নিন্দা ও মন্তব্য করা হয়েছে অস্ট্রেলিয়া, বৃটেন, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, ভারত, জাপান ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন এক বিবৃতিতে বলেছেন, গণতন্ত্র, স্বাধীনতা, শান্তি ও উন্নয়নের জন্য মিয়ানমারের জনগণের যে আকাঙ্ক্ষা তাদের সেই আকাঙ্ক্ষার পাশে আছে যুক্তরাষ্ট্র। ওদিকে ইয়াঙ্গুনে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস থেকে নাগরিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতার বিষয়ে মার্কিন সব নাগরিকদের সতর্ক করা হয়েছে। মিয়ানমারে ব্যবসায় বড় একটি দাতাদেশ জাপান। সেখানকার ক্ষমতাসীন দলের একটি সূত্র বলেছেন, মিয়ানমার যে অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে তাতে তাদের সঙ্গে প্রতিরক্ষা বিষয়ক সম্পর্ক শক্তিশালী করার বিষয়ে নতুন করে চিন্তাভাবনা করতে পারে জাপান। এর মধ্য দিয়ে এ অঞ্চলে চীনের প্রভাবের পাল্টা ব্যবস্থা নিতে পারে তারা। মিয়ানমারের সব পক্ষকে সংবিধানের প্রতি সম্মান দেখানোর আহ্বান জানিয়েছে চীন। একই সঙ্গে স্থিতিশীলতা সমুন্নত রাখতে আহ্বান জানানো হয়েছে বিবৃতিতে। তবে তারা মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানে নিন্দা প্রকাশ করেনি। শান্তিপূর্ণ সমাধানের আহ্বান জানিয়েছে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া। কিন্তু এর থেকে একহাত বেশি এগিয়ে গিয়েছে থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও ফিলিপাইন। থাইল্যান্ড সরকার মিয়ানমারের অভ্যুত্থানকে তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে উল্লেখ করেছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে এ দেশগুলো।
আগেই অভ্যুত্থান আতঙ্ক ছিল
নভেম্বরে মিয়ানমারে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনের আগেই সেখানকার ক্ষমতাধর সেনাবাহিনী নির্বাচনের সুস্থতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে থাকে। তারা নির্বাচন শুরুর আগেই তাদের রাজনৈতিক শক্তি বা ক্ষমতা প্রদর্শন করতে থাকে। নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কড়া সমালোচনা করতে থাকে। এর ফলে নির্বাচন অবাধ এবং সুষ্ঠু হবে- তা নিয়ে তারা সংশয় প্রকাশ করতে থাকে। সেনাবাহিনীর এমন হুমকি ও হুঁশিয়ারির ফলে মিয়ানমারে নতুন করে একটি সামরিক অভ্যুত্থানের আশঙ্কা আগে থেকেই দেখা দেয়। কিন্তু সেনাপ্রধান মিন অং হ্লাইং প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিলেন নির্বাচনে জনগণের ইচ্ছার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করবে সেনাবাহিনী। তার সেই প্রতিশ্রুতির পর মানুষের মধ্যে কিছুটা স্বস্তি দেখা গিয়েছিল। করোনাভাইরাসের ভয়াবহ সংকটের মধ্যেও গত ৮ই নভেম্বর জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনী কর্তৃপক্ষের কড়া সমালোচনা সত্ত্বেও সেখানে শতকরা ৭১.৭৫ ভাগ বৈধ ভোটার নির্বাচন কেন্দ্রে গিয়ে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন। মিয়ানমারের মোট ভোটার প্রায় তিন কোটি ৭০ লাখ। এসব ভোটার সংখ্যাগরিষ্ঠ সমর্থন জানিয়েছেন ক্ষমতাসীন ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসির প্রতি। ফলে জাতীয় নির্বাচনে আরো একবার ভূমিধস পরাজয়ের শিকার হয় সেনাবাহিনী মদতপুষ্ট ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (ইউএসডিপি)। তারা দাবি করে ভয়াবহ জালিয়াতি হয়েছে নির্বাচনে। এ অভিযোগে তারা পুলিশ স্টেশনে এবং নির্বাচন কমিশনে কয়েক হাজার অভিযোগ জমা দেয়। তাদের পক্ষে অবস্থান নেয় সেনাবাহিনী এবং তারা নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ করতে থাকে। পরিচালনা করে একটি তদন্ত। নির্বাচনের পর বেসামরিক পারসন অং সান সুচির নেতৃত্বাধীন সরকার যখন প্রথম পার্লামেন্ট অধিবেশন করতে যাবে, ক্ষমতা হাতে নিতে যাবে- ঠিক সেই মুহূর্তেই সেনাবাহিনী মিয়ানমারে ক্ষমতায় হস্তক্ষেপ করেছে। এর মধ্য দিয়ে তারা এনএলডি’র বিজয়কে অস্বীকার করেছে। ওদিকে নির্বাচনে ভোট জালিয়াতির অভিযোগকে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের মতো প্রমাণহীন এবং ‘ট্রাম্পইজম’ বলে আখ্যায়িত করেছেন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া বিষয়ক পরিচালক ফিল রবার্টসন।
অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান- সুচি
সামরিক অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে জনগণকে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন মিয়ানমারের বেসামরিক নেত্রী অং সান সুচি। তার দল মিয়ানমার ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসির (এনএলডি) ফেসবুক ভেরিফাইড অ্যাকাউন্টে তার পক্ষে একটি বিবৃতি প্রকাশ হয়েছে গতকাল। তাতে সুচির পক্ষে পোস্টে বলা হয়েছে, জনগণের সামরিক অভ্যুত্থান মেনে নেয়া উচিত হবে না। তাদের উচিত এর বিরুদ্ধে রাস্তায় নামা। ফেসবুকে এই একাউন্ট নির্বাচনী প্রচারণার সময় ব্যবহার করেছে এনএলডি। সেখানে পোস্ট করা বিবৃতিতে বলা হয়েছে, গতকাল মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটেছে। তবে এ বিষয়ে এনএলডির কোনো পদস্থ কর্মকর্তার মন্তব্য পাওয়া যায়নি। গতকাল ভোরে অং সান সুচিকে আটক করেছে সেনাবাহিনী। তারপর থেকে তাকে কোথায় রাখা হয়েছে বা তিনি কেমন আছেন তা জানা যাচ্ছে না। এই অভিযানে সেনাবাহিনী এনএলডির গুরুত্বপূর্ণ নেতা ও কর্মীদেরও আটক করেছে। ফেসবুকে অং সান সুচির নামে একটি বিবৃতি দেয়া হয়েছে। তাতে তার কোনো স্বাক্ষর নেই। এতে সুচি বলেছেন, সেনাবাহিনীর এই কর্মকাণ্ড দেশকে আবার স্বৈরাচারের অধীনে নিয়ে যাবে। জনগণের প্রতি আহ্বান জানাই এটা মেনে নেবেন না। এর প্রতিবাদ জানান। সর্বান্তকরণে দেশে সেনাবাহিনীর এই অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করুন। বিবৃতিটি ইস্যু করেছেন এনএলডির চেয়ারম্যান উইন হতেইন। এর নিচে তার হাতের লেখা একটি নোট রয়েছে। ফলে এই বিবৃতি যে যথার্থ তা পরিষ্কার এবং এতে অং সান সুচির ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটেছে।