বন্ধুত্ব ,স্ট্যাটাস ও অন্যান্য : ডাঃ সাদিয়া মনোয়ারা ঊষা

87

ক্লাস সিক্সে পড়ি তখন, নতুন স্কুলে ঢুকলাম। নতুন সব বন্ধুরা। বন্ধুদের মধ্যে ছোট ছোট গ্রুপ ছিল। প্রথম গ্রুপ পড়াশোনায় অসাধারণ, কে প্রথম কে দ্বিতীয় হবে কার বাসায় কয়জন হোমটিউটর রয়েছেন -এগুলো তাদের আলোচনার মুখ্য বিষয়।এরা খুব বেশি স্টাইলিশ ছিল না। দ্বিতীয় গ্রুপ পড়াশোনাকে এতোটা সিরিয়াস না নিলেও জীবনযাত্রায় দারুন স্টাইলিশ ছিল। কয়েকজন ছিল সমমনা, লোক সংখ্যা বেশী ছিলনা বলে এরা গ্রুপ হতে পারেনি, এরা দুই গ্রুপের সাথে সুসম্পর্ক ভাল রেখে চলতো। মোটামুটি গ্রুপ বিহীন কেউ ছিল না । নতুন কেউ ক্লাসে এলে এই দু-তিন ধরনের গ্রুপের যে কোন একটিতে প্রবেশ করার জন্যে বেশ যোগ্যতার পরিচয় দিতে হতো। যে ব্যক্তি কোন গ্রুপের কাছে আপন হয়ে উঠতে পারতোনা(!) তার জন্য ক্লাসটা হয়ে উঠত বিষ। এখন যদি জিজ্ঞাসা করেন ক্লাস সিক্সে পড়া ছাত্র-ছাত্রী কাউকে গ্রুপে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য যোগ্যতার মাপকাঠি হিসেবে কি নির্ধারণ করেছিল এই বিষয়ে জ্ঞান আমার খুবই কম। এর মধ্যে একজনকে আমার ভীষন ভালো লাগতো। ওর আমার বোঝাপড়াটা খুব সুন্দর ছিল। আমরা দুজন টিফিন পিরিয়ডে টিফিন শেয়ার করতাম, বড় শিশুগাছটার নিচের দোলনা গুলোতে দোল খেতাম, সারা মাঠ জুড়ে দৌড়ঝাঁপ করে বেড়াতাম। আমাদের এই সুখ বেশিদিন সইল না। একদিন আমাদের বাংলা ক্লাস টিচার বললেন, তোমাকে তো ভালো মেয়ে বলেই জানি। তোমার বাবা-মা খুব সজ্জন মানুষ। তুমি এই মেয়েটার সাথে কেন মিশছো? আমি অবাক হলাম ,কেন স্যার ?ওতো খুব ভালো মেয়ে। বাংলার স্যার বেশ রাগতস্বরে ইংরেজি আওড়ালেন, The man is known by the company he keeps. (সঙ্গ দেখে লোক চেনা যায়।) আমার একমাত্র বন্ধুর সাথে আমার বন্ধুত্ব ভেঙে গেল। স্যার পছন্দ করেনা, তাই আমাদের বন্ধুত্ব রইল না। স্যারের প্রতি আমার অবিচল বিশ্বাস। সেই বিশ্বাসে ওর সম্পর্কে স্যারের বলা প্রত্যেকটা কথা আমার কাছে সঠিক বলে মনে হল। মেয়েটি বড় বড় চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকত ,খেলা করবে বলে আমার সাথে। আমি ফিরে তাকাতাম না। রোজ আমার জন্য সীট রেখে দিত। অজুহাত দেখিয়ে বসতাম না। আশ্চর্য যে আমার প্রতি কোন অভিযোগ ছিল না। এদিকে আমি ভীষণ চেষ্টা করে চলেছি হাইপ্রোফাইল গ্রুপের সাথে মেশার জন্য। নিজেকে কোন একটি গ্রুপের গর্বিত সদস্য ভাবার জন্য। আমার বন্ধুটি পরের বছরই অন্য সেকশনে চলে যায়। পরের বছরগুলোতে এত দমবন্ধ শিডিউলে নিজেকে বেঁধে ফেলি যে , বন্ধু শব্দটি কোন অচেনা শব্দ বলে আমার জীবনে প্রতীয়মান হয়। বহুদিন পর ফেসবুকের মাধ্যমে পরিচয় হলো। আমার বন্ধুটি ঠিক তেমনই আছে ।বড় বড় চোখ। সেই স্নিগ্ধ দৃষ্টি ।দুদিন আলাপ করার পরে আমার মনে হল যেন আমার আর ওর জন্মই হয়েছে দুজনের বন্ধু হবার জন্য ।আজ এতটা বছর পরেও আমি যা ভাবি আর ও যা ভাবে টা এক মোহনায় এসে মিশে যায়। যে গান আমার ভালো লাগে, সেই গানটি ইনবক্সে ওর অনুরোধ হিসেবে আসে ।যে স্ট্যাটাস আমি দেবো বলে মনে করি আমার আগেই সে স্ট্যাটাস দিয়ে রাখে। আজ আমরা কত দূরে থেকেও কত কাছের। অথচ এক সময় এক হাতের মধ্যে থেকেও আমরা বন্ধু হতে পারি নি। শুধুমাত্র কারো অহেতুক কু মনের মধ্যে ঢুকিয়ে দেবার জন্য। শুধু মিথ্যে হাইপ্রোফাইল সেজে থাকার জন্য । সবাইকে জানানোর জন্য আমি একটা ফাস্ট ক্লাস গ্রুপে বিলং করি। কি হাস্যকর তাই না!! ছোটবেলার এগুলো হাস্যকর নয় ।তখন আমাদের বোধবুদ্ধি বিচার-বিবেচনা কতইবা? হাস্যকর তখন হয় ,যখন বড় হয়েও আমরা এই মেকী বিষয়গুলো বজায় রাখতে থাকি। একজন লেডি অফিসারকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে টং এ চা পান করতে দেখে গাড়ির কালো কাঁচ উঠিয়ে তার সিনিয়র মুখ বাঁকা করে বললেন, ‘এ কোন অফিসার! কোন ক্লাস মেইনটেইন করে না?’ সিনিয়র কোন ভুল কথা বলেননি। সরকারি অফিসারদের অনেক নিয়ম কানুন। কিন্তু পুঁথিগত ভাবে জনগণের সেবক আর বাস্তবে জনগণ দেখলেই গাড়ির মধ্যে ঢুকে নির্দিষ্ট দূরত্বে থেকে অফিসার সুলোভ পদমর্যাদা বজায় রাখা। এই জায়গাটা যদি কেউ আমাকে বুঝিয়ে দিতেন খুব ভালো হতো। কিসের স্টাটাস ?কিসের হাই প্রোফাইল? কাকে দেখাচ্ছি? কি দেখাচ্ছি? কেন দেখাচ্ছি? কেউ রাস্তায় দাঁড়িয়ে চা খাবে আপনি হয়তো খাবেন ফাইভ স্টার এ । সেই চায়ের টেবিলে আপনার সমমনা স্ট্যাটাসের ব্যক্তিকে জোর গলায় বলতে পারবেন তো,’ যে কাজটা করলেন, মোটেই ভালো করেননি ,এর জন্য আপনাকে দুদক ধরতেই পারে।’ থাকবে তো আপনার স্ট্যাটাস? স্ট্যাটাস যাওয়ার ভয়ে কত অন্যায় আপনি সহ্য করে নিয়েছেন ভেবে দেখুন তো। স্ট্যাটাসে স্ট্যাটাসে আবার গন্ডগোল। ধরুন,ঘুষের টাকায় আপনি বাড়ি করেছেন। আপনার বাড়িতে একজন প্রকৌশলী বসবাস করে। কিন্তু আপনার বাড়ি ওয়ালা স্ট্যাটাস এর কাছে তার সব স্ট্যাটাস বৃথা। আপনার হাজব্যান্ড বড় কোম্পানির মালিক। আপনি শাড়ির রঙের সাথে মিলিয়ে গাড়ি নিয়ে পার্টিতে ঢুকেন। আপনার গয়নার স্ট্যাটাস মুকেশ আম্বানির বউয়ের সাথে তুলনীয়। সেই স্ট্যাটাস এর কাছে মধ্যবিত্ত সরকারী চাকরিজীবী বউয়ের স্ট্যাটাস যেন মাটিতে মিশে যায়। Status যার বাংলা অর্থ সামাজিক পদমর্যাদা, সামাজিক সুযোগ-সুবিধা ,ভারসাম্য বজায় রাখার এক বহু প্রাচীন পদ্ধতি। কিন্তু যুগ বদলেছে। সমাজে অনেক মুক্তমনা মানুষ রয়েছে যারা এই বুলশিট স্ট্যাটাস এর ধার ধারে না। কঠিন এর সাথে কঠিন ,কোমলের সাথে কোমল হৃদয় হওয়ার যোগ্যতা রাখে । আমাদের নবীজি কোন জাতপাত ধনী-গরীব বিভেদ করে সাহাবী নির্বাচন করেননি। সেইসব সাহাবীদের পদমর্যাদা কোথাও কম ছিল কি? ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রাজা রামমোহন রায় ,বেগম রোকেয়া, মাদার তেরেসা, এরা কি ভেবে যে তাদের স্ট্যাটাস নষ্ট করে সমাজের অবাঞ্ছিতদের আপন করে নিয়েছিলেন তা কে জানে। মূল পার্থক্য হচ্ছে দৃষ্টিভঙ্গির। সমাজকে আপনার কূপমন্ডুপ জ্ঞানের মধ্যে দিয়ে বিচার করা টাই ভুল। সমাজ অত্যন্ত গতিশীল । সমাজের চলার সাথে নিজেকে প্রগতিশীল করতে না পারেন, মিথ্যা অহংবোধ আর মায়ার জাল সৃষ্টি থেকে বিরত থাকুন। যে স্ট্যাটাস যে পদমর্যাদা ব্যক্তি নিজে অর্জন করে তা ছোট ছোট কাজে কখনো হারিয়ে যায় না। যা হারিয়ে যায় তা অর্জিত নয়। সমমনা মানুষেরা একত্রে থাকবে । এতে রাশি রাশি উদারতার পরশ অনুভব হবে। অহংকার এর জন্মটা কোথা থেকে হয়?? যে স্ট্যাটাস নিয়ে এতো বড়াই করেন, সেই স্ট্যাটাসে বিলং করে এমন কোন লোককে কাল পুলিশ দুর্নীতি বা ধর্ষণের দায়ে ধরে নিয়ে গেলে সবাইকে জোর গলায় বলতে পারবেন তো, The man is known by the company he keeps!!!

                                                                               ডাঃ সাদিয়া মনোয়ারা ঊষা