গবেষণা রিপোর্টের তথ্য : খুলনা ওয়াসার পানি সরবরাহে গ্রাহক অসন্তুষ্টি :স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতায় ঘাটতি :উত্তরণে পাঁচ দফা সুপারিশ

11

খুলনা ওয়াসা’র পানি সরবরাহ ব্যবস্থাপনাসহ অন্যান্য সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে (সততা বা শুদ্ধাচার ব্যবস্থাপনা) গ্রাহকদের মধ্যে ব্যাপক অংশের অসন্তুষ্টির চিত্র ফুটে উঠেছে। অসন্তুষ্টির মধ্যে একদিকে প্রতিষ্ঠানটির স্বচ্ছতা- জবাবদিহিতায় ঘাটতি, অন্যদিকে কার্যক্রমে জনগণের অংশগ্রহণ না থাকা এবং কর্তৃপক্ষের দ্বারা দুর্নীতিবিরোধী পদক্ষেপ গ্রহণ না করার বিষয়টিও উঠে এসেছে।
সম্প্রতি এক গবেষণা রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, উল্লিখিত ক্ষেত্রে ওয়াসার প্রতি গ্রাহকদের ৭ ভাগ সম্পূর্ণ অসন্তুষ্ট, ১২ ভাগ জনগোষ্ঠী খুব বেশি মাত্রায় অসন্তুষ্ট এবং ২০ ভাগের মধ্যে সন্তুষ্টি-অসন্তুষ্টি দু’টিই রয়েছে। তবে ১৯ ভাগ খুব বেশি সন্তুষ্ট এবং ৪২ ভাগ সন্তষ্ট বলে অভিমত তুলে ধরেছেন। এছাড়াও সমন্বয়হীনতা এবং সেবার মানসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে সমস্যা উত্তোরণে পাঁচ দফা সুপারিশ করা হয়েছে।
বেসরকারি সংস্থা ‘ওয়েভ ফাউন্ডেশন’ উল্লিখিত গবেষণা রিপোর্টটি প্রকাশ করেছে। প্রতিষ্ঠানটি খুলনা ও রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনে ‘পানি, পয়ঃনিষ্কাশন এবং স্বাস্থ্যবিধির ঝুঁকি মোকাবেলায় পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন খাতে জবাবদিহিতা বৃদ্ধির জন্য সহায়তা’ শীর্ষক প্রকল্প বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে ‘পানি ও পয়ঃনিস্কাশন খাতে শুদ্ধাচার ও সুশাসন বাস্তবায়নের অবস্থা, চ্যালেঞ্জ, সুযোগ ও করণীয়’ শীর্ষক এ গবেষণা পরিচালনা করা হয়। ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে শুরু হওয়া এক বছর মেয়াদের এ প্রকল্প ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে শেষ হবে।
গবেষণা রিপোর্টে পানি ও পয়ঃনিস্কাশন খাতে জবাবদিহিতার প্রক্রিয়া সম্পর্কে নাগরিকদের ধারণা সংক্রান্ত বিষয়ে আরও উল্লেখ করা হয়, পানি ও পয়ঃনিস্কাশন খাতে জবাবদিহিতার প্রক্রিয়া এবং অনুশীলনসমূহ বিভিন্ন সূচকের মাধ্যমে নির্ণয় হয়ে থাকে। যেমন: অভিযোগ বাক্স থাকা, অভিযোগ গ্রহণ ও নিস্পত্তি, অভিযোগের সমাধান প্রক্রিয়া এবং এ বিষয়ে সচেতনতামূলক কর্মসূচি ইত্যাদি।
গবেষণা জরিপে ৩৪ ভাগ উত্তরদাতা জানিয়েছেন, ওয়াসার কোথাও কোনো অভিযোগ বাক্স নেই, ৪৫ ভাগ বলেছেন, তারা জানেই না যে কোথায় অভিযোগ বাক্স আছে।
৪৮ ভাগ উত্তরদাতা বলেছেন, তারা এখনও কোন অভিযোগ দায়ের করেননি। অন্যদিকে ৩৪ ভাগ জানিয়েছেন, কর্তৃপক্ষের কাছে যে অভিযোগ জানানো যাবে- সেই বিষয়টিই তারা জানেন না।
উত্তরদাতাদের ৩০ ভাগ বলেছেন, অভিযোগের বিষয়ে প্রতিকার পাবার কোনো ব্যবস্থা তাদের জানা নেই এবং ৩৬ ভাগ বলেছেন, অভিযোগের প্রতিকার সম্পর্কে তারা কিছুই জানে না। ২৪ ভাগ জানিয়েছেন, ওয়াসার প্রচারাভিযান কার্যক্রম সম্পর্কে জানেন না।
আর উত্তরদাতাদের ৫৩ ভাগ বলেছেন, ওয়াসার কোন ধরণের সচেতনতা বৃদ্ধিমূলক কার্যক্রম সম্পর্কে তাদের ধারণা নেই।
গবেষণার সার্বিক পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে রিপোর্টে বলা হয়েছে, পানি এবং পয়ঃনিস্কাশন খাতের শুদ্ধাচার প্রতিষ্ঠার উদ্যোগসমূহ জনপ্রিয় না হওয়ার অন্যতম সমস্যা সেবা সংস্থা (কেসিসি, ওয়াসা, কেডিএ, ওজোপাডিকো, বিটিসিএল) গুলোর মধ্যে আন্তঃসমন্বয়ের ঘাটতি, সুশাসনের সকল নির্ণায়ক বা সূচক সম্পর্কে সাধারণ নাগরিকদের সচেতনতার অভাব, অংশগ্রহণমূলক পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং গণশুনানিতে জনগণের অংশগ্রহণ কম, অনেকক্ষেত্রে যথাযথ অভিযোগ দায়ের এবং অভিযোগ নিস্পত্তি প্রক্রিয়া সক্রিয় না থাকা, কেন্দ্র হতে আরোপিত নিয়ম-কানুন এবং স্থানীয় চাহিদা সনাক্তকরণের নিয়ম-নীতির অনুপস্থিতি এবং দুর্নীতিবিরোধী পদক্ষেপের দৃশ্যমান অনুপস্থিতি ও এ বিষয়ে নাগরিকদের মধ্যে অনীহা।
গবেষণা রিপোর্টে পানি ও পয়ঃনিস্কাশন খাতে জবাবদিহিতা নিশ্চিতে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক পরিকল্পনা, বাজেট মনিটরিং এবং গণশুনানীতে নাগরিকদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি এবং যথাযথ সমন্বয় প্রয়োজন- উল্লেখ করে ৫ দফা সুপারিশ করা হয়েছে। সুপারিশগুলো হচ্ছে- সুপেয় পানি ও পয়ঃনিস্কাশন সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয় জোরদার, সেবার মূল্য তালিকা সকল ওয়ার্ডে প্রেরণ, নাগরিকদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন করতে ব্যাপকভাবে সচেতনতা বৃদ্ধিমূলক কার্যক্রম গ্রহণ ও বাস্তবায়ন, প্রয়োজনে সিটিজেন চার্টার হালনাগাদ, সচেতনতামূলক তথ্য সম্বলিত বিলবোর্ড স্থাপন এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার, পানি ও পয়ঃনিস্কাশন খাতে জবাবদিহিতা নিশ্চিতে বিভিন্ন সামাজিক জবাবদিহিতার পদ্ধতি অংশগ্রহণমূলক পরিকল্পনা, বাজেট মনিটরিং এবং গণশুনানীতে নাগরিকদের জানানো এবং অংশগ্রহণে উৎসাহিত করা, ব্যবহারযোগ্য সহজে অভিযোগ দায়ের এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের রিড্রেস ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী করণ, সাধারণ মানুষের জন্য অনলাইনে অভিযোগ করার পাশাপাশি বিভিন্ন পয়েন্টে অভিযোগ বক্স স্থাপন, জরুরী পরিস্থিতিতে (প্রচন্ড তাপদাহে ও দুর্যোাগকালীন সময়ে) পানি ও পয়ঃনিস্কাশন কর্তৃপক্ষ নাগরিকদের মাঝে বিশুদ্ধ খাবার পানি সরবরাহ নিশ্চিত করা ইত্যাদি।
এ বিষয়ে খুলনা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ আবদুল্লাহ, পিইঞ্জ. বলেন, খুলনা ওয়াসা শুদ্ধাচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ২০০৯ সাল থেকে কাজ করছে এবং এ লক্ষ্যে বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করে যাচ্ছে। ২০০৯ সালে যেখানে ওয়াসার বিলিং সিস্টেম ছিল স্লিপ ভিত্তিক। কিন্তু এখন ওয়েব সাইটের মাধ্যমে একজন গ্রাহক তার বিল সম্পর্কে জানতে পারছেন এবং ব্যাংক এর মাধ্যমে পানির বিল প্রদান করছে। গ্রাহকসেবা নিশ্চিতে খুলনা ওয়াসা নিয়মিত গণশুনানীর আয়োজন করে। তিনি আরও বলেন, ওয়াসার সেবার মূল্য তালিকা সকল ওয়ার্ডের কমিশনাদের লিখিত আকারে প্রেরণ করা হবে যাতে করে সকল গ্রাহকরা ওয়াসার সেবা সম্পর্কে জানতে পারেন। সর্বপরি ওয়েভ ফাউন্ডেশন পরিচালিত গবেষণার সুপারিশের আলোকে ওয়াসা সমস্যা সমূহের সমাধান বের করবে।
অ্যাডভোকেসি সভা :
বুধবার (১৫ মে) খুলনা ওয়াসার সভাকক্ষে ওয়েভ ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে গবেষণা প্রাপ্ত তথ্য, বিশ্লেষণ এবং সুপারিশসমূহের আলোকে ‘খুলনা সিটি কর্পোরেশন এলাকায় সুপেয় পানি ও পয়ঃনিস্কাশন খাতের বর্তমান অবস্থা, চ্যালেঞ্জ, সুযোগ ও করণীয়’ শীর্ষক অ্যাডভোকেসি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় উপস্থিত ছিলেন খুলনা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ আবদুল্লাহ, পি ইঞ্জ.খুলনা সিটি কর্পোরেশনের সচিব (অতিরিক্ত দায়িত্ব) সানজিদা বেগম, খুলনা ওয়াসার সহকারি প্রকৌশলী আব্দুর রাজ্জাক, খুলনা সিটি কর্পোরেশনের সহকারি পরিচ্ছন্নতা কর্মকর্তা মোঃ আব্দুর রাকিব, এনজিও ফোরাম খুলনার আঞ্চলিক ব্যবস্থাপক মোঃ লুৎফর রহমান, সাংবাদিক মুহাম্মদ নূরুজ্জামান,
ওয়েভ ফাউন্ডেশনের উপ-পরিচালক কানিজ ফাতেমা, প্রকল্প সমন্বয়কারী লিপি আমেনাসহ স্থানীয় লোকমোর্চার সদস্য এ্বং নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিবৃন্দ।
সিটি কর্পোরেশনের সচিব সানজিদা বেগম বলেন, গবেষণার সুপারিশের আলোকে সকলকে পানি ও পয়ঃনিস্কাশন খাতের সমস্যা সমাধানে একসাথে কাজ করতে হবে। জনগণ ওয়াসার সেবাসমূহ সম্পর্কে জানলে তাদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে ওয়াসা কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে।
এসডিজি লক্ষ্য ৬ অনুসারে ২০৩০ সালের মধ্যে শতভাগ মানুষের কাছে নিরাপদ পানি পৌঁছে দিতে বিদ্যমান চ্যালেঞ্জসমূহ দূরীকরণে প্রত্যেক মানুষের কাছে নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন পৌঁছাতে সরকার অনেক নীতি ও পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করছে। তা সত্বেও এখনও পানি পরিষেবা ও ব্যবস্থাপনায় জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতার অনেক ঘাটতি রয়েছে। তাই সকলের জন্য মানসম্মত সুপেয় পানি নিশ্চিতকরণে পানি ও পয়ঃনিস্কাশন খাতে জবাবদিহিতা নিশ্চিতে বিভিন্ন সামাজিক জবাবদিহিতার পদ্ধতি অংশগ্রহণমূলক পরিকল্পনা, বাজেট মনিটরিং এবং গণশুনানী সম্পর্কে নাগরিকদের জানানো এবং অংশগ্রহণে উৎসাহিত করা এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের মধ্যে যথাযথ সমন্বয় দরকার বলে এই অ্যাডভোকেসি সভায় অংশগ্রহণকারীরা মতামত তুলে ধরেন।