বাল্যবিবাহ হয় ছারখার,অবলা নারীর জীবন

177
।।যশোর থেকে উৎপল ঘোষ।।
শিশুরা জাতীর অমূল্য সম্পদ। শিশুদের প্রতি দায়িত্ববোধ এবং মমত্ববোধে উজ্জীবিত হয়ে প্রতি বছর আমরা নানা দিবস পালন করি।পালন করি জাতীয় কণ্যা শিশু দিবসও।এসব দিবস আমাদের কতটা সচেতন করেছে?বিপজ্জনক কাজে দ্বিধাহীনভাবে বিশেষ করে ।শিশু ভৃত্যের ওপর নির্যাতন করে তাকে মেরে ফেলা,বাল্যবিবাহের উচ্চহার ইত্যাদি বারবার মনে করিয়ে দেয় আমাদের ভিতরকার মধ্যযুগীয় বর্বরতার কথা।বাল্যবিবাহ একটি সামাজিক ব্যাধি যা অংকুরেই মহীরুহের সম্ভাবনাকে গলা টিপে মারে।
তথ্যনুসন্ধানে জানা যায়, প্রতিদিন দেশে মাধ্যমিক বিদ্যালয়,ও মাদ্রাসার পড়ুয়া ছাত্রীদের বাল্য বিবাহ হচ্ছে। নিকাহ রেজিঃ কাজীরা এমন কৌশল অবলম্বন করে ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। নিকাহ রেজিঃ কাজীরা ঘরোয়া কলমা দিয়ে খোলা ফরমে নাম মাত্র সহি করে চলে যায়। কিছুদিন যেতে না যেতেই অধিকাংশ সংসারে অশান্তির ছায়া নেমে আসে।কারণ সংসার সম্পর্কে এ সমস্ত কম বয়সী অবলা শিশু রা জানে না সংসার জীবন কি? এ সমস্ত অবলা শিশুদের বয়স১৩ – ১৮ এর কম। যার কারণে কিছু  দিন যেতে না যেতেই ছাড়া ছাড়ি হয়ে যায়।
জাতিসংঘ  জনসংখ্যা তহবিলের (ইইউএনএফপিএ) এক হিসেব অনুযায়ী বাংলাদেশে নারীদের গড় বিয়ের বয়স প্রায় এক যুগে আগে ছিল ১৬ দশমিক ৯ বছর।বাল্যবিবাহের শিকার কিশোরীদের ৫৯ -৬০ ভাগের বয়স চৌদ্দ থেকে সতের পৌঁছানোর আগেই তারা মা হয়ে যায়।১৯২৯ সালের বাল্য বিবাহ নিরোধ অনুযায়ী বাল্য বলতে সেই বিবাহকে করা হয়েছে যেখানে
 সম্পর্ক স্থাপনকারীরা ২১ বছরের কম বয়সী পুরুষ এবং১৮ বছরের কম বয়সী মেয়ে।প্রচলিত বতর্মান আইন যা নিশিদ্ধ।মুসলিম বিবাহ আইন অনুযায়ী বিবাহ হতে হবে প্রাপ্তবয়স্ক পাত্র-পাত্রীর সম্নতি অনুসারে।প্রাপ্ত বয়স্ক হলেই কেবল এই সম্মতি ও সমর্থন দেয়া সম্ভব।অবশ্য যে সমস্ত জরিপের তথ্য,আমরাগ্রহণ করি তার গ্রহণযোগ্যও বোঝার উপায় নেই।কেননা জন্ম নিবন্ধন ব্যবস্থা এদেশের তেমন প্রচলিত নয়।আবার যারা বিয়ে পড়ান তারাও অভাভাবকের দেয়া জন্ম তারিখের উপর নির্ভর করেন।সঠিক তথ্য সংগ্রহের দায়িত্ববোধ করেন না।
বিয়ে সব দেশের সংস্কৃতিতেই একটি আনন্দঘন অনুষ্ঠান।বাল্যবিবাহ এ আনন্দের মূলে কূঠারাঘাম করে।শিক্ষা-সচেতনতার অভাব,দারিদ্র,যৌতুকপ্রথা,মেয়ে শিশুর প্রতি বৈষম্যমূলক,দৃষ্ঠিভঙ্গি, সামাজিক কুসংস্কার নিরাপত্তার অভাব,নিজের অধিকার সম্পর্কে নারীর অজ্ঞতা,পরুষের বহুগামিতা ইত্যাদি এদেশে বাল্য বিবাহের উল্লেখযোগ্য কারণ।জণ্ম থেকেই কণ্যাশিশুর প্রতি বৈষম্যের ফলাফল প্রায় ষাট শতাংশ কণ্যা শিশুর চরম অপুষ্টি এবং পাঁচ বছরের নিচের কণ্যা শিশুর উচ্ছ মৃত্যু হার।প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে বৈষম্য কমলেও মাধ্যমিকে এসে মেয়েদের ঝরে পড়ার হার বেশি।বাল্য বিবাহ এসব মেয়ে শৈশব -কৈশরের করুণ সমাপ্তি ঘটিয়ে রাতারাতি তাকে প্রাপ্ত বয়স্ক হতে বাধ্য করে যার দায়িত্ব নিতে সে অক্ষম।তার শিক্ষা,স্বাস্থ্য,নিরাপত্তা ও পরিপূর্ণ বিকাশের মৌলিক অধিকার হয় ব্যহত,তার প্রজনন অধিকার হয় খর্বিত,গর্ভকালীন নানা জটিলতায় মা ও শিশু স্বাস্থ্য হয় বিঘ্নিত,দীর্ঘ প্রজননকাল জনসংখ্যা বিস্ফোরণের কারণ হয়। সে এমন এক যৌন দাসত্বের স্বীকার হয় যার উপর তার নিজের কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না।পরিবার-পরিকল্পনা অধিদপ্তরের প্রতিবেদন অনুযায়ী এদেশে প্রতি হাজারে৪.২ জন হিসাবে লাখে পাঁচ শত জন মায়ের মৃত্যু হচ্ছে।প্রতিবছর প্রায় পাঁচ লাখ পঞ্চাশ হাজার নারী গর্ভকালীন জটিলতা ফিস্টুলা,জরায়ূর স্থানচ্যুতিসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।অপুষ্ঠ মা জন্ম দেন মৃত অথবা অপুষ্টি সন্তান।বাড়ে শিশুর মৃত্যু হার।স্বল্প ওজন বামনত্ব সমস্যা বুদ্ধিমত্তার দিক থেকে এসব শিশু পিছিয়ে পড়া সবই বাল্যবিবাহের ফলাফল।প্রায় ৪৭ শতাংশ কিশোরী রক্ত শুন্যতায় ভোগে।বিশ্ব ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী অপুষ্টির কারণে বাংলাদেশকে প্রতিবছর আনুমানিক প্রায় দেড় বিলিয়ন ডলার সমমানের ক্ষতির সম্নুখিন হতে হয়।জাতি বঞ্চিত হচ্ছে উৎপাদনশীলতা থেকে বাল্যবিবাহের মানসিক প্রভাবও খুব মারাত্মক।অপরিণত বৃদ্ধি,বিবাহোত্তর বিষন্নতা,ভগ্ন স্বাস্থ্য তাকে এমন অসহায় অবস্থানে নিয়ে যায়, যার ফলে সে সহজেই গার্হস্হ্য সন্ত্রাসের শিকার হয়।বধু নির্যাতন বধূ হত্যার তালিকা দীর্ঘ হয়।নতুবা সদ্যকৈশর পুরোনো ভগ্ন স্বাস্থ্য এসব স্ত্রীকে স্বামীরা ত্যাগ করে। তখন এদের অবস্থা হয় শোচনীয়।
১৯৮৯ সালে একবার জাতীসংঘের সাধারণ পরিষদে গৃহীত শিশু অধিকার সনদে স্বাক্ষরকারী দেশ সমুহের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম।১৯৯০ সালে অনুষ্ঠিত বিশ্ব শিশু সম্নেলনে অংশগ্রহণকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ ও শিশুর প্রতি দায়িত্ববোধ, ভালোবাসা ও গভীর মমত্ববোধ থেকে শিশুর মৌলিক ও মানবিক অধিকার প্রতিষ্ঠত করতে দায় ও অঙ্গীকারবদ্ধ। উল্লেখ্য সকলকে সচেতন করার উদ্দেশ্যে ২০০০- ২০১০ দশকে শিশু অধিকার  বাস্তবায়ন দশক হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।শিশু অধিকার সনদে স্বাক্ষরের পরিপেক্ষিতে ১৯৯৪ সালে সরকার প্রণয়ন করেছেন  জাতীয় শিশুনীতি।এতে শিশুর জন্ম, বেঁচে থাকা,শিক্ষা ও মানষিক বিকাশ পারিবিরিক পরিবেশ বিশেষ অসুবিধাগ্রস্থ শিশুদের সাহায্য সর্বোত্তম স্বার্থ.আইনগত অধিকার ইত্যাদি বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল।আমরা মনে করি,সময়োচিত নতুন ও সঠিক নীতিমালা ও ব্যাপক প্রচারে আভিভাবকজকে সচেতন করে তুলবে।মেয়ে শিশু সমাজের বোঝা নয়।বরং উপযুক্ত শিক্ষা ও সুযোগ পেলে সেও মা-বাবার দায়িত্ব বহনে সক্ষম এ মানষিকতা গড়ে তোলার ব্যাপারে মিডিয়ার ভূমিকা সবচেয়ে ফলপ্রসু।বাল্য বিবাহের ফলে শিশুর মানবিধকার লংঘিত হয়।তার দৈহিক -মানষিক বৃুদ্ধিবৃত্তিক আবেগের উপর চিরস্থায়ী নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।যেন শিশুরা শোষনহীন সমাজে অধিকার ও মর্যাদা নিয়ে বেড়ে উঠতে পারে।