এখন নওয়াপাড়ায় ২০ হাজার কোটি টাকার বানিজ‍্য

110

উৎপল ঘোষ (ক্রাইম রিপোর্টার ) যশোর :

যশোর জেলার অভয়নগর অতি প্রাচীন জনপদ।দিন বদলের সাথে উপজেলার প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত ভৈরব নদী।জেলার সদর রাজারহাট, বসুন্দিয়া,অভয়নগর,ফুলতলা ও দৌলতপুর উপজেলার এককালে শ্রোতস্বী ভৈরব আজ মৃত প্রায়। তার অপমৃত‍্যুতে আমদানিকৃত পণ‍্য সামগ্রী পরিবহণ করতে হয় সড়ক পথে এতে নদী পথের চেয়ে সড়ক পথে খরচ হয় কয়েকগুণ বেশি ।যা পণ‍্যের ওপর বর্তায়, পরিশ্রম বাড়ে এবং সময়ের অপচয় হয় বেশি।
দেশের দক্ষিম – পশ্চিম ও উত্তরাঞ্চলে উন্নয়ন ঘটাতে হলে ভৈরব নদী চরের জায়গা উদ্ধার সহ সংস্কারের কোন বিকল্প নেই। ড্রেজিং করে তার নাব‍্যতা ফিরিয়ে আনতে হবে। নদী খননের কর্মসুচির আওতায় এনে উত্তরে পদ্মার সাথে সংযোগ দিয়ে প্রকৃত শ্রোতের ব‍্যবস্থা করতে হবে।স্বাভাবিক শ্রোত যাতে কোন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্ঠ করতে না  পারে সে লক্ষ্যে নদীর উভয় পাড়ের অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করতে হবে। লঞ্চ, কার্গ চলাচল নিশ্চিত করতে হলে  সরকার এ খাত থেকে পাবে হাজার হাজার কোটি টাকা রাজস্ব। ফলে পরিবহণ খরচ সাশ্রয় হবে এবং চাল, ডাল,গম  সারসহ বিভিন্ন পণ‍্য  সামগ্রীর  মূল‍্য কমে যাবে। তাছাড়া ইরিগেশন প্রকল্প বৃদ্ধি পাবে ও ফসল উৎপাদনের লক্ষ‍্যমাত্রা অর্জিত হবে।
অভয়নগরের একমাত্র প্রাণ ভৈরব।নদীর তীরে গড়ে ওঠা ছোট্ট শহরের নাম নওয়াপাড়া। এই শহরে রয়েছে অসংখ্যা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শিল্প প্রতিষ্ঠান। নদের চরে গড়ে উঠেছে দু’টি চামড়ার মিল। লেদার ও এস এ এফ।যোগাযোগ ব‍্যাবস্থা অন‍্যান‍্য উপজেলার তুলনায় ব‍্যতিক্রম।কারণ এখানে রয়েছে তিন পথের যোগাযোগ। যেমন স্থল, নৌ ও রেলপথ। এখানে প্রায় দেড় যুগ ধরে ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে বৃহত্তম বানিজ‍্য কেন্দ্র।১৮৭৫ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ মার্চ বাঘুটিয়া ইউনিয়নের অভয়নগর মৌজায় অভয়নগর সদর থানা প্রতিষ্ঠিত হলে পুরো এলাকা অভয়নগর থানা নামে পরিচিত পায়।থানা হিসেবে জেলার মধ্যে অতি পুরাতন।অভয়নগর থানাটিও ভৈরব নদীর  তীরে অবস্থিত।অভয়নগরউপজেলার উপর দিয়ে প্রবাহিত ভৈরব নদী।অভয়নগর আদিকাল হতে উর্বর হিসেবে খ‍্যাত। নদী বাহিত হওয়ার কারণে এর আয়তন কখনও স্থিতাবস্থায় ছিল না।মূলত ভৈরব, গঙ্গা,পদ্মা,হুগলি ও ভাগীরথী নদীর পলির মাটিময় প্রাসাদে অভয়নগর উপজেলার উৎপত্তি।ভূ -সৃষ্ঠির প্রারম্ভে ভূখণ্ডটি ক্রমশ গভীর জঙ্গলে পরিণত হয়ে বর্তমান সুন্দর বনের চেয়েও ঘন অরণ‍্যে ঢেকে গিয়েছিল।বাঘ,হাতি,গন্ডার ও হরিণসহ হিংস্র অহিংস বিভিন্ন প্রকার প্রাণীর আবাসস্থল হয়ে ওঠে আজকের জনারণ‍্য অভয়নগর। বাধাপ্রাপ্ত বিশাল জলরাশির সাগরসঙ্গমে অনুমান ২০ হাজারের বছর পূর্বে অভয়নগর গড়ে ওঠে।চার হাজার বছর আগেও অভয়নগর উপজেলায় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ছয়টি দ্বীপে বিভক্ত ছিল। আজ সেই দ্বীপও নেই,জঙ্গলও নেই,হিংস্র পশুর কোন অস্তিত্বও নেই।আছে শুধু নামে মাত্র ভৈরব।ভৈরব নদীর সীমানা ধীরে ধীরে  গ্রাস করছে ভূমিদস‍্যুরা।যা দেখার কেউ নেই। সে নিজেই আজ ডুকরে ডুকরে কাদঁছে। এই নদের উত্তর – পূর্ব জনপদে চারটি ইউনিয়ন ও দক্ষিণ -পূর্ব জনপদে চারটি ইউনিয়ন এবং একটি পৌরসভা রয়েছে।
এককালের খরশ্রোতা ভৈরব নদীতে ষ্টীম ইঞ্জিন চালিত জাহাজ চলতো বলে জনশ্রুতি আছে। যে নদকে কেন্দ্র করে আজ সবকিছু সেই ভৈরব নদী আজ ধুঁকে ধুঁকে মরতে বসেছে। নেই আজ তার প্রাণের যৌবন।ভৈরব নদীর পানিকে নানাভাবে অত‍্যাচার করা হচ্ছে। ভুমি দস্যুদের কারণে সবকিছু আজ হারাতে বসেছে।ফারাক্কার করাল গ্রাসের শিকার নিপতিত হয়ে ভৈরবের উত্তরাংশ প্রায় আশি ভাগ মরে গেছে। অভয়নগর অংশের ভৈরবের যতটুকু নাব‍্যতা অবশিষ্ট আছে সেটার অস্তিত্ব এখন চরম হুমকির মুখে। ভৈরবের অভ‍্যন্তরে ঢালাই পিলার তুলে পাঁকা ইমারত নির্মাণ করায় ভৈরবের  স্বাভাবিক গতির প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হচ্ছে। চরের জায়গা দখল করে নির্মাণ করা হচ্ছে হোটেল, চায়ের ষ্টলসহ দালাল কোঠা।
সঙ্গত কারণে প্রবাহ বাঁধার ফলে ক্রমাগত পলি পড়ে নদীর তলদেশ উঁচু হয়ে নাব‍্যতার সৃষ্টি হচ্ছে। আমদানিকারক ব‍্যবসায়ীদের পণ‍্য সামগ্রী ভর্তি কার্গো,লঞ্চ যাতায়াতে শিল্প ও বানিজ‍্য শহর নওয়াপাড়ার ভৈরব অংশে যেটুকু নাব‍্যতার অংশ ছিল ভূমি খেকোগংদের নানা অবর্ণনীয় নির্যাতন অত‍্যাচারে তা আজ সংকটপন্ন। ভৈরবকে শেষ রক্ষায় এবং এখানকার ব‍্যবসা বানিজ‍্য অস্তিত্বকে ধরে রাখতে বিগত বাংলাদেশ সরকারের নৌপরিবহন মন্রালয় বিগত ২০০৩ সালের ২৫ আগষ্ঠ যার স্মারক নং নৌপরিবহন /টিএ শা-৮/এম /১১ /২০০৩( অংশ – ১) ৩৭১। নৌপরিবহন বন্দর বাস্তবায়ন করতে বিআই ডব্লিউটিএ একে নির্দেশ দেয়।
সংশ্লিষ্ঠ কতৃপক্ষ নওয়াপাড়াতে এসে প্রাথমিক কার্যক্রম শেষ করে মন্ত্রণালয়ে রিপোর্ট দাখিল করে।বিগত ২০০৪ সালে ৫মে গেজেট প্রকাশিত করে যার প্রজ্ঞাপন নং এস আর ও ১১৭আইন/২০০৪ PORTS – ACT 19O8(ACT – XVOF 19O8) – এর SECTION – 4 এর subsection – 1- (a) এবং( 2) –  এ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে সরকার নওয়াপাড়াকে নদী বন্দর ঘোষণা দেয়।মন্ত্রালয়ের সিনিয়র সচিব মানিক চন্দ্রের স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, ভৈরবের নাব‍্যতা এবং নদীর স্বাভাবিক গতির প্রবাহ অব‍্যহত করার লক্ষ্যে টাস্কফোর্সের সুপারিশ এবং মন্ত্রী পরিষদের গৃহীত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে যশোর অভয়নগর উপজেলা নওয়াপাড়াকে নদী বন্দর ঘোষণার প্রশাসনিক অনুমোদন দেয়া হয়।মর্মে নৌপরিবহন মন্ত্রালয় বিআইডব্লিউটি একে বন্দর বাস্তবায়নের নির্দেশ দেয়।
নদীর জায়গা দখল :
“”””””””””””””””””””””””””””
সঙ্গত কারণে কতৃপক্ষ সীমানা নির্ধারণ করে নওয়াপাড়ার পৌরসভার মহাকাল শশ্নানঘাটের উজানে উত্তরাংশ এবং দক্ষিণে ভাটপাড়া এলজিইডি ফেরিঘাটের উপর আড়াআড়ি উত্তর দক্ষিণ বরাবর অভয়নগর সহ – ভূমি অফিস কতৃক যশোর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) বরাবরে প্রেক্ষিতে আবেদনে (স্মারক নং ৪৬৬/ভূমি) এবং স্মারক সংখ‍্যা ১৭৭৮/ (২) এস এ তাং; ১০/০৭/১৯৯৫ ইং উল্লেখ আছে।নওয়াপাড়া বাজার সংলগ্ন ভৈরব তীরে অবস্থিত ব‍্যক্তিমালিকানাধীন নির্মিত ৫১ টি কার্গো / বার্জ ঘাটের কথা। নওয়াপাড়া খাস জমি তথা ভৈরব শহর পাড়ের ৩টি মৌজায় ৮৫ জন ব‍্যাক্তি ৭০২ শতক খাস জমি ভোগ দখল করছেন বলে উল্লেখ আছে। অভয়নগরবাসীর দীর্ঘদিনের প্রাণের দাবী নওয়াপাড়াকে বন্দর হিসেবে পূর্ণ বাস্তবায়িত করার। কিন্তু প্রাথমিক কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর অজ্ঞাত কারণে তা বন্ধ হয়ে গেছে। জনসাধারণ সঙ্গত কারনেই হতাশায় ভুগছেন। বন্দর পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন হলে বহু মানুষের কর্মসংস্থানের পাশাপাশি সরকারের কোটি কোটি টাকা রাজস্ব আয় হবে।
বন্দর নগরীর অভয়নগর উপজেলাবাসীর সেই লালিত স্বপ্নের ভৈরব নদের ওপর সেতুটি নির্মিত হয়েছে।সেতু চালু হওয়ায় যোগাযোগ ব‍্যবস্থা ও ব‍্যবসা বানিজ‍্য আরো বৃদ্ধি পাবে উত্তর- পূর্ব জনপদে। ভৈরব নদের ওপর নির্মিত নুতুন সেতুর ওপর  দাঁড়ালেই চোখে পড়ে অসংখ্যা সারি সারি জাহাজ।এসব জাহাজগুলোতে রয়েছে কয়লা, পাথর,সিমেন্ট, ভূট্টা,বালি ও খাদ‍্যশষ‍্য। অন‍্য জাহাজগুলোতে রয়েছে যাবতীয় কৃষি উৎপাদনের রাসায়নিক সার। কুলিরা ঝুঁড়িতে করে এসব পণ্য মাথায় নিয়ে কাঠের সিঁড়ি ও বাঁশের সাঁকো বেয়ে জাহাজ থেকে নামছে শত শত শ্রমিকেরা। বৃহত্তম এ ব‍্যবসা কেন্দ্র হচ্ছে যশোরের ছোট্ট একটি উপজেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে গেছে ভৈরব নদ এবং যশোর – খুলনা রেলপথ ও মহাসড়ক। এই তিন পথ নওয়াপাড়ায় সমান্তরালে মাত্র ২০০ – ২৫০ মিটার দূরত্বে রয়েছে।স্থল – রেল – নৌ এই ত্রিমাত্রিক যোগাযোগ সুবিধার থাকার কারণে দেশের অন‍্যতম ব‍্যবসা কেন্দ্র হিসাবে পরিচিত লাভ করতে শুরু করেছে প্রায় এক যুগের অধিক।
প্রতি বছরে বিদেশ থেকে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার অধিক আমদানি পণ‍্য খালাস করা হয়। এখান থেকে সারাদেশে যাবতীয় পণ‍্য ছড়িয়ে পড়ে। যাবতীয় রাসায়নিক সার,কয়লা,সিলেট বালি,পাথর ও যাবতীয় খাদ‍্যশস‍্য। এখানেই শুধু আমদানি পণ‍্য শেষ নয়, প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার আভ্যন্তরীণ পণ‍্যের বড় বাজার বন্দর নগরী নওয়াপাড়ায়। সব মিলিয়ে শিল্প শহর নওয়াপাড়ায় এখন ২০ হাজার কোটি টাকার বানিজ‍্য কেন্দ্রস্থল ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে।
ভৈরব নদ কেন্দ্র করে আজ যে ছোট্ট বানিজ‍্যিক শহর নওয়াপাড়া গড়ে উঠেছে তার অবদান আজ ভৈরব নদী। সেই ভৈরব কালের ছোবলে হারিয়েছে তার প্রাণের যৌবন।যে নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে এই ব‍্যবসা কেন্দ্র সেই ভৈরব আজ ধুঁকছে। ভূমিদস‍্যুদের দখল ও ভরাটের কারণে কোথাও শীর্ণ আকার ধারণ করেছে।বন্দর নগরী নওয়াপাড়ার ব‍্যবসায়ী ও শ্রমিকদের দাবির পরও দখলমুক্ত হচ্ছে না।ভৈরব নদীর  দক্ষিণ পাড়ের চরের জায়গাই বেশী ভূমি ।নিয়মিত খনন হচ্ছে না। যা হচ্ছে ইচ্ছামত।

ব‍্যবসায়ীরা অভিমত ব‍্যক্ত করে বলেছেন,
অষ্টেলিয়া,মরক্কো,সৌদি,জর্ডান,কানাডা,ইন্দোনেশিয়া,ফিলিপাইন,চীন ও ভারত থেকে জাহাজে করে আমদানি করা সার ও বিভিন্ন প্রকার খাদ‍্য শস‍্য, কয়লা,চট্টগ্রাম ও মংলা ব্ন্দরে আসে।সেখান থেকে ছোট জাহাজে করে শিল্প শহর ন,পাড়ায়  আনা হয়। ভারত থেকে স্থল পথে আমদানি করা পণ‍্য ট্রেনে ও ট্রাকে করে বেনাপোল এবং ট্রেনে করে দর্শনার স্থল বন্দর হয়ে নওয়াপাড়ায় আনা হয়। প্রতিদিন ৪৫০ থেকে ৫০০ পণ‍্য বোঝাই জাহাজ নওয়াপাড়ায় ভৈরব নদীতে অবস্থান করে। সেখান থেকে আনলোডের পর এসব পণ‍্য প্রতিদিন স্থল পথে প্রায় এক হাজারের অধিক ট্রাকে করে এবং নদী পথে ট্রলারে করে দেশের দক্ষিণ এবং দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে নেওয়া হয়।
নওয়াপাড়ায় সার,সিমেন্ট ও খাদ‍্যশস‍্য ব‍্যবসায়ী সমিতির সাধারণ ব‍্যবসায়ী সাধারণ সম্পাদক শাহ জালাল এর সঙ্গে মুঠোফোনে এই আমার দেশকে বলেন, নব্বই দশকের প্রথম দিকে বেসরকারীভাবে নওয়াপাড়ায় সার বাবসা শুর হয়। পরবর্তীতে অনুমোদন হয়।তখন বিদেশ থেকে আমদানি করা সারের ৬৮ – ৭২ শতাংশ নওয়াপাড়া  থেকে বিপনন হতো।বর্তমানে ৪০- ৪৫ শতাংশ নওয়াপাড়া বিপনন হয়।ধীরে ধীরে সারের সঙ্গে সিমেন্ট, রড, পাথর এবং সর্বশেষ প্রায় সাত বছর কয়লার ব‍্যবসা যুক্ত হয়েছে।ব‍্যবসা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে।এই ব‍্যবসাকে কেন্দ্র করে নওয়াপাড়ায় প্রায় তিন শতাধিক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে।কয়লার ব‍্যবসা একটি লাভজনক ব‍্যবসা। অনেকেই এই ব‍্যবসা করে বনে গেছে।
গতকাল যশোর থেকে নওয়াপাড়ায় ফিরে আসার সময় সড়কপথে নওয়াপাড়ায় প্রবেশ করতেই সড়কের পাশে একাধিক পাহাড় সমান দাহ‍্য পদার্থ কয়লার স্তুপ চোখে পড়ে। যা নিয়মবহির্ভূত।সড়ক ছেড়ে ভৈরব নদীর দিকে যেতেই দেখা গেল শ্রমিকদের কর্মযজ্ঞ। জাহাজ থেকে কুলিরা মাথায় করে গমের বস্তা ও  রাসায়নিক সারের বস্তা নামাচ্ছিলেন উত্তম বর্মণ (৪৫) ও কালাম শেখ (৩৮)। দুই জন প্রায় ছয় বছর ধরে ঘাট শ্রমিকের কাজ করেন। বিশ্রামের সময় বলেন,সারা বছর ঘাটের মালামাল লোড আনলোডের কাজ করে থাকি।সপ্তাহে ছয়দিন কাজ চলে।সব মিলিয়ে ৭০০ – ৮০০ টাকা উপার্জন হয়।পরিবার পরিজন নিয়ে ভালো আছি। নদীর যে পরিবেশ তাতে মনে হচ্ছে আর অর্ধ যুগ পরেই পণ‍্যবাহী বার্জ,কার্গো জাহাজ প্রবেশ করতে পারবে না।কারণ নদী যে ভাবে খনন করার দরকার সেভাবে হচ্ছে না।
আর্থিক লেনদেনের জন্য এখানে রয়েছে ১৩টি রাষ্ট্রয়ত্ত ও বেসরকারী ব‍্যাংকের শাখা, আছে অর্ধশতাধিক অর্থলগ্নিকারী প‍্রতিষ্ঠান।প্রতিদিন লেনদেন হয় কয়েকশত কোটি টাকা।প্রায় এক কিলোমিটার এলাকায় বছর জুড়ে চলে এ কর্মযজ্ঞ। এই ছোট খাটো শহরে ব‍্যবসা বানিজ‍্য অর্ধলক্ষাধিক মানুষের কর্মসংস্থানের ব‍্যবস্থার সৃষ্টি করেছে।
উপজেলায় তালতলায় অবস্থিত নওয়াপাড়া নদী বন্দরের কার্যক্রম শুরু হয় ২০০৭ সালের মে মাসে।বাংলাদেশ আভ‍‍্যন্তরীন নৌপরিবহন কতৃর্পক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) হিসাব অনুযায়ী উপজেলায় ভৈরব নদীর তীরে অবৈধ স্থাপনা ছিল ৮৬ টি।২০১৬ অক্টোবরের মধ্যে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ও বিআইডব্লিউটিএর সহযোগিতায় দুই ধাপে ৫৯টি স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়। বাকী ২৭টি স্থাপনা পর্যায়ক্রমে উচ্ছেদের কথা বলা হয়েছিল।যা এখনও অসমাপ্ত।যশোর সদরে দড়াটানা রোডের পাশেই ভৈরব নদী।নদের জায়গা দখল করে ৮৭ টি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন ব‍্যবসায়ীরা।২০১৯ সালের ১৮ই এপ্রিল জেলা প্রশাসকের সভাকক্ষে যশোরের ভৈরব নদীর উচ্ছেদকৃত অবৈধ দখলদারদের পূর্ণবাসনের লক্ষ্যে সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
নওয়াপাড়া নদী বন্দরের একটি মহল বলছে ,অভয়নগরের ভাটপাড়া থেকে মহাকাল শ্লশানঘাট পযর্ন্ত নদীর তীরে দুই পাড়ে ৬কিলোমিটার করে ১২ কিলোমিটার এলাকায় রয়েছে এসব অবৈধ স্থাপনা।অবশিষ্ট ২৭ টি স্থাপনার মধ্যে আঞ্চলিক কর কমিশনারের ভাড়া করা কার্যালয়। নওয়াপাড়ার প্রভাবশালী ব‍্যবসায়ীর গুদাম রয়েছে।এ কারণে তখন আর উচ্ছেদ অভিযান আর অগ্রগতি হয়নি।
করোনাকালে শ্রমিকের পরিবর্তে যান্ত্রিক(লং বুম এক্সাকাভেটর) দিয়ে বার্জ, কার্গো ও কোষ্টার থেকে পণ‍্য খালাস করতে নদের মধ্যে ২২টি জেঠি নির্মাণ করা হয়।মাটি বালু,ইট ও খোয়া ফেলে ভরাট করে তৈরী এসব জেটি আর পরে অপসারণের ব‍্যবস্থা করা হয়নি।
উক্ত জেটি অপসরণসহ তিন দফা দাবিতে মানব বন্ধন, সমাবেশ এবং নদী বন্দরের কার্যালয় ঘেরাও করেন পৌর হ‍্যান্ডলিং শ্রমিকেরা। তাদের তিন দফা দাবী — ভৈরব নদী থেকে জেটি সরাতে হবে, নদী খনন করে নাব‍্যতা ফিরিয়ে আনতে হবে এবং উপজেলার রাজঘাট থেকে চেঙ্গুটিয়া পযর্ন্ত নদের তীরে সাইডওয়াল তৈরী করতে হবে।
নওয়াপাড়া নদী বন্দর কর্তৃপক্ষের সহকারী পরিচালক শাহ আলম প্রতিবেদককে বলেন, আমরা ১৪ ও১৫ ডিসেম্বরে অভিযান চালিয়ে ২৫ টি স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছে। ভবিষ্যতে আরও অভিযান চলবে। নদে ড্রেজিং চলমান রয়েছে। এখন আর নাব‍্যতার সংকট নেই।সাইডওয়াল নির্মাণের বিষয়টি মন্ত্রালয়ে অনুমোদিত হয়েছে।অল্প দিনের মধ্যে নির্মাণের কাজ শুরু করা যাবে।
গতকাল সরেজমিনে দেখা যায় যে,২৭টি স্থাপনা উচ্ছেদের কথা ছিল,সেগুলো কোনটিও উচ্ছেদ করা হয়নি। এর বাইরে কয়েকটি জেটি সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেগুলো আবার স্থাপনা করা হয়েছে।
যে ভৈরব নদীকে কেন্দ্র করে ব‍্যবসা কেন্দ্রটি টিকে রয়েছে সেই ভৈরব নদী সচল না থাকলে হাজার হাজার শ্রমিক কাজ হারানোর সম্ভাবনা।পৌর হ‍্যান্ডলিং শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি ফাল্গুন মন্ডল প্রতিবেদককে বলেন,এখানে মৌসুমে ৩৫ থেকে ৪০ হাজার শ্রমিক এবং অন‍্য সময়ে ২৮ থেকে ৩০ হাজার কর্মযোজ্ঞ করেন। তারা প্রতিনিয়ত জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেন। কিন্তু নদী না থাকলে শ্রমিকদের কাজ থাকবে।
উক্তস্থানে শত শত কয়লার স্তুপে পরিবেশ দুষন
——————————————————————-
যশোর —খুলনা মহাসড়ক ও রেলপথ এবং ভৈরব নদীর পাড়ে খোলা আকাশের নিচে প্রায় শতাধিক কয়লা ও রাসায়নিক সারের স্তুপ লক্ষ‍্য করা গেছে। রাসায়নিক সার এভাবে খোলা আকাশের নিচে ড‍্যাম্পিং করে মজুদ রাখার কোন নিয়ম নাই।প্রতিদিন কোন না কোন প্রশাসন খুলনা – নওয়াপাড়া হয়ে যশোরসহ অন‍্য জেলায় প্রবেশ করেন কারোর দৃষ্টিতে পাহাড় সমান স্তুপগুলো কী চোখে পড়ে না? এতে পরিবেশ মারাত্মকভাবে দুষিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এর বিরুদ্ধে এলাকার বাসিন্দারা ও স্কুল ও কলেজ পড়ুয়ারাও বিভিন্ন সময়ে প্রতিবাদ ও মানব বন্ধন করেছেন। এ নিয়ে একাধিক বিভিন্ন পত্রিকা সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে ফলাওভাবে।অবশেষে ১৯ ফেব্রুয়ারি২০২০ইং অভয়নগর উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনে জেলা প্রশাসকের সভাপতিত্বে সভা অনুষ্ঠিত হয়।সভায় নওয়াপাড়া আবাসিক এলাকা এবং যশোর — খুলনা মহাসড়ক ও রেলপথের পাশ থেকে পাহাড় সমান স্তপ করা কয়লা ও রাসায়নিক সার এক সপ্তাহের মধ্যে সরানোর সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু সে সিদ্ধান্তের আলোর মুখ এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। যা হয়েছে তা যতসামান‍্য।
স্থানীয় বাসিন্দা ও কয়লা শ্রমিকেরাা বলেন,প্রায় সময় পাহাড় সমান স্তুপে আগুন ধরে ধোঁয়ার কুণ্ডলি ওঠে তখন শ্রমিকেরা পানি ছিটান। আশপাশের গাছগুলো মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে। অনেক কয়লা থেকে বিষাক্ত দূর্গন্ধও বের হয়।ভৈরব ও মহাসড়কের পাশে রয়েছে ২০ টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
কোমলমতি শিশু  ছাত্র–ছাত্রী শিক্ষকেরাও কয়লার দূষণে শিকার হচ্ছে, ঘরবাড়ি ও কাপড় ধুলায় ধূসর হয়ে যাচ্ছে।
কয়লা লোড আনলোডের কাজে যুক্ত শ্রমিক লতিফ যেমন বললেন,কয়লা বহন করলে চোখ জ্বালাপোড়া করে,রাতে ঠিকমত ঘুম হয় না।বাঘুটিয়া শ্রমিক উওম বর্মণ বলেন, যাদের চর্মরোগ, এলার্জি,ও শ্বাসকষ্ঠ তাদের সারা শরীর চুলকায়। বিশেষ করে সন্ধার পর। অনেক শ্রমিক আছেন তারা শ্বাস কষ্ঠের সমস‍্যার কারণে কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে।
ভৈরব নদী খনন :
“”””””””””””'”‘”””””””””
৪৩ কোটি ৯৫ লাখ টাকা ব‍্যয়ে ২০১৭ সালে ১৯ ফেব্রুয়ারি থেকে ভৈরব নদী খননের কাজ শুরু করা হয়।বিআইডব্লিউটিএ সুত্র জানায়,খুলনা থেকে নওয়াপাড়া ভৈরবের দৈর্ঘ্য প্রায় ৩৪ কিলোমিটার।এর মধ্যে খুলনা থেকে শিরোমনি পযর্ন্ত প্রায়  ১৫ কিলোমিটার।ভৈরব নদীর অবস্থা মোটামুটি ভালো।শিরোমনি থেকে নওয়াপাড়া পযর্ন্ত ১৯ কিলোমিটার।ভৈরবের অবস্থা বেশ মরনাপন্ন। ভৈরবের সবচেয়ে খারাপ অবস্থা নওয়াপাড়া নদী বন্দরের  প্রায় সাড়ে ১২ কিলোমিটার এলাকা।সব মিলিয়ে নৌপথটির সাড়ে ২৭ কিলোমিটার খননের কাজ চলছে। চলতি বছরে খননের কাজ শেষ হবে।
নওয়াপাড়া নদী বন্দরের জেটি আছে। নাম প্রকাশে বেশ কয়েকজন ব‍্যবসায়ী বলেন, নদীর তীর থেকে জেটি ও পল্টনের দূরত্ব বেশ.দূরে।এই জন‍্য সময়.ও খরচ বেড়ে যায়। এ জন‍্য ব‍্যবসায়ীরা এগুলো ব‍্যবহার করে না বন্দর কর্তৃপক্ষ ওয়‍্যার হাউজের সুবিধা বাড়ায়নি। নদী ভাঙ্গন রুখতে গাইডওয়াল পণ‍্য ওঠা নামানোর জন‍্য স্থায়ী সিঁড়ি ও মালবাহী ট্রাকের জন‍্য পার্কিং ইয়াড নির্মাণ করা হয়নি।ব‍্যবসায়ী মহল রাজস্ব দিয়েও কাঙ্কিত সেবার মান পাচ্ছেন না।
নওয়াপাড়া নদী বন্দর দিয়ে প্রতি বছর পণ‍্য আমদানি বাড়ছে। যশোর চেম্বারঅব কমার্সের সাবেক সভাপতি আমদানিকারক মিজানুর রহমান বলেন, ব‍্যাবসা অনুযায়ী ব‍্যবসায়ীদের সুযোগ- সুবিধা বাড়ছে না। সব ধরণের জাহাজ যাতে নওয়াপাড়ায় সে জন‍্য সারা বছর ভৈরব নদটি খনন করতে হবে।বন্দরের অবকাঠামো ও সেবার মান বাড়লে ব‍্যবসায়ীরা আরো আগ্রহী হবেন। কর্মজীবী লোকের কর্মসংস্থানের ব‍্যবস্থাসহ ব‍্যবসা বানিজ‍্য আরো বৃদ্ধি পাবে।

শিল্প শহর নওয়াপাড়ার ভৈরব নদী